চা শিল্পের ইতিহাস
চা শব্দের উৎপত্তি:
চীনের একটি উপজাতীয় ভাষা অময় (Amoy)। এই অময় ভাহসার শব্দ 'তে' (te) থেকে পরর্বর্তীতে ক্যান্টনিজ ভাষায় চা (Cha) শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে বলে জানা যায়। চা শব্দটি পারস্য, পর্তুগীজ, জাপান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভাষায় সাদরে গৃহীত হয়েছে। তবে 'তে' (te) নামটি থেকে আরেকটি অপভ্রংশ 'Tea' ইংরেজি ভাষা প্রভাবিত বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজরা এ উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করার পূর্বেই ফারসি ভাষার অন্যান্য শব্দের সাথে 'চা' শব্দটি বাংলা ভাষায় স্থাপন করে নেয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, 'চা' শব্দটি সরাসরি চীন থেকে এ উপমহাদেশে আসেনি, এসেছে ফারসি ভাষা থেকে।
চায়ের পরিবেশঃ
ভূমি, জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ চায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চা গাছ এমন একটি কৃষিজাত ফসল যে তার বৃদ্ধিতে কিছুটা আরণ্যক পরিবেশ পছন্দ করে। উষ্ণ অ আদ্র পরিবেশ যেখানে তাপমাত্রা ২৬°-২৮° সেঃ এবং বৃষ্টিপাত ২০০০ মিমি এর উপরে ও বাতাসে জলীয় অংশ অর্থাৎ ৭০-৯০%, সে জায়গা চায়ের বৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ। এছাড়া দিবালোকের স্থায়িত্ব ১২ ঘন্টার কাছাকাছি, মাটি অম্লধর্মী (পিএইচ ৪.৫ থেকে ৫.৮), বেলে-দোয়াশ ও সন্তোষজনক পুষ্টিমানসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। চা গাছ মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে নে। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি কোনটাই চায়ের অনুকূল নয়। প্রচুর পানি যেমন দরকার তেমনই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও নিশ্চিত থাকা জরুরী।
চায়ের উদ্ভিদতত্ত্ব
চায়ের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Camellia sinensis L. সকল চা গাছ একই প্রজাতিভূক্ত। ১৭৫৭ সালে সুইডিশ উদ্ভিদ শ্রেণিতত্ত্ববিদ ক্যারোলাস লিনিয়াস তার প্রকাশিত Species Plantraum নামের বইয়ের প্রথম খন্ডের ৫১৫ পৃষ্ঠায় চা কে Camellia sinensis হিসাবে তালিকাভুক্ত করেন। একই বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে তিনি শোভাবর্ধক চায়ের আরেকটি জাতকে Camellia japonica নামে অভিহিত করেন। Thea এবং Camellia প্রথম দিকে আলাদা Genus হলেও পরবর্তী সময়ে Thea জেনাসে চা কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। Thea একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ দেবী। সেই হিসাবে চা কে ঐশ্বরিক গুল্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৮১৮ সালে ইংরেজ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট সুইট এবং ১৮২২ সালে প্রকৃতি বিজ্ঞানী হেনরিক ফেডারিক চা কে Thea জেনাসের পরিবর্তে Camellia জেনাসে এর অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে বর্তমানে বাংলাদেশে চায়ের দু'টি প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে আবাদ করা হয়। তন্মধ্যে একটি Camellia sinensis এবং অপরটি Camellia assamica.
উদ্ভিদ উৎপত্তি বিশারদগণ বলেছেন চায়ের উৎপত্তিস্থল বা আদিবাস বর্তমান সুদূর উত্তর চীন ও মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে। কিন্তু এর বিস্তৃতি আজ উত্তর চীন থেকে দক্ষিণ আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। বাহ্যিক গঠনভেদে চা গাছ প্রধানত দু'টি জাত বড় পাতাওয়ালা আসাম জাত ও ছোট পাতার চীনা জাতে ভাগ করা হয়। এছাড়া মাধ্যমিক গঠনের কয়েক প্রকার উপজাতেও শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। যেমন-মণিপুরী, বার্মা, হাইব্রিড ইত্যাদি।
চা গাছ ছেঁটে না রাখলে মাঠে ৩ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ছাটাইয়ের পরে নতুন গজান বিটপের অতি কোমল অংশ অর্থাৎ কুঁড়ি ও তার কিছু নিচ অবধি নরম ডগা থেকেই ভাল চা হয়। আর আদর্শ পরিবেশে একটি গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক চয়ন ৫০ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে। এরপর গাছ উৎপাদনক্ষম থাকলেও লাভজনক থাকে না। বরং তখন উহা উপড়ে ফেলে (uprooting) নতুন করে আবাদি করাই উত্তম।
চায়ের ইতিহাসঃ
চায়ের জন্ম সুদূর চীন দেশেই। যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও ২৭৩৭ বছর আগের কথা। সে সময়কার চীনের সম্রাট শেন নাং পানির সাথে চায়ের কয়েকটা পাতা মিশিয়ে পান করে গরম পানি পান করা অপেক্ষা কিছুটা ভিন্ন স্বাদ অনুভব করেন এবং সম্রাট শেন নাং চা’কে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দেন। সেই থেকেই আজও চা স্বাস্থ্যরক্ষায় ব্যবহার হয়ে আসছে। ঐ সময় শুধুমাত্র রাজা ও রাজপরিবার সদস্যবৃন্দ ঔষধ হিসেবে চায়ের আস্বাদন নিতে পারত। চা নিয়ে প্রচলিত একটি উপকথার কথাই বলা যাক। এক বনে এক সন্নাসী ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ তার খুব নিদ্রা পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই নিদ্রা দূর করতে পারছিল না। এতই ঘুম যে চোখের দুটি পাতা আপনিই ভারী হয়ে বুজে আসে। সাধনায় চোখের পাতা দুটি খুবই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। সন্নাসী রাগে চোখের পাতা দুটোকে ছিড়ে ফেলে দিল। চোখের পাতা ছেড়ার ব্যাথায় আপাতত ঘুম চলে গেল। যেখানে চোখের পাতা দুটি ফেলা হয়েছিল সেখানে মাটি ফুড়ে গজিয়ে গেল ছোট্ট একটি সুন্দর গাছ। সন্নাসী গাছটির পাতা ছিড়ে নিজের চোখের উপর রাখলেন কিন্তু পাতা দুটি তার চোখে জোড়া না লাগায় সন্নাসী ভীষন ক্ষেপে পাতা দুটি চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন। এতেই ঘটে গেল এক অলৌকিক কান্ড। সন্নাসীর নিদ্রা দূর হয়ে গেল। জানি এ শুধুই উপকথা। কিন্তু আজও যখন আমরা বলি চা খেলে ঘুম আসে না সেটাকি এই উপকথার সূত্র ধরেই। এটি প্রতীয়মান হয় যে চা শুধু ঔষধি পানীয়ই নয় এটা ক্লান্তি দূর করে ও শরীরকে চাঙ্গা করে। চা (ইংরেজি ‘টি’) শব্দটা এসেছে চীন দেশের ‘te’ থেকে। কম্বোডিয়া ভাষায় এর নাম ‘cha’ এবং ওই নাম নিয়েই সে বিশ্ব ভ্রমন করেছে, গেছে জাপান, ইরান, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং এসেছে আমাদের ভারতেবর্ষে।
চীনের পরে জাপানেই চা আবাদ শুরু হয়। ইসাঈ (১৪১১-১২১৫) নামের এক ধর্ম প্রচারক চীন থেকে জাপানে প্রথম চা বীজ নিয়ে যান এবং তাঁকেই জাপানের চা শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় চা প্রবর্তন করা হলেও বাণিজ্যিকভাবে চা আবাদ শুরু হয় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান থেকে বীজ বপন করে। পরে ১৮৭৮ সালে ভারতের আসাম থেকে বীজ দিয়ে চা আবাদ শুরু হলে ইন্দোনেশিয়াতে চা আবাদ লাভজনক হয়ে উঠে। ভারতের চা চাষের সফলতায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে অন্যান্য দেশেও চা চাষ আরম্ভ করে। শ্রীলঙ্কাতে কফি গাছে পাতার মোড়ক দেখা দিলে ১৮৭০ সনের পর শ্রীলঙ্কাতে কফি প্রতিস্থাপন করে ব্যাপকভাবে চা আবাদ আরম্ভ হয়। আফ্রিকার মালাউতে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। বিংশ শতাব্দীর কুড়ি এবং ত্রিশের দশকে কেনিয়া, তানজানিয়া এবং উগান্ডায় চা আবাদ শুরু হয়। ১৮৪৬ সালে রাশিয়াতে প্রথম চা রোপণ করা হলেও প্রথম সাফল্যজনক আবাদ জর্জিয়াতে শুরু হয় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া তাইওয়ানে ১৮১৫, তুরস্কে ১৮৩৯, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে চা প্রবর্তন করা হয়।
ভারত উপমহাদেশে চাঃ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানা কারণে চীন এবং পার্শববর্তী দেশগুলোয় বাণিজ্যিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। চা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই সমস্যায় পড়তে হয় কোম্পনীকে। তাই উনিশ শতকের শুরুতে কোম্পানীকে নতুন ভাবনায় পড়তে হয়। জন কোম্পানী অধিকৃত ভারতে চা চাষের নতুন সম্ভাবনার মধ্যে সমস্যাটির সমাধান খুজে পায়। আসামের জঙ্গলে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে মেজর স্কট এবং ক্যাপ্টেন সিএ ব্রুস বা লেঃ চার্ল্টন চা গাছ আবিষ্কার করেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম চীন থেকে চা বীজ আনা হয়য় বলে জানা যায়। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে জোসেফ ব্যাংক (উদ্ভিদতত্ত্ববিদ) হিমালয়ের পাদদেশে চা আবাদের সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন। তার প্রায় একশ বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী রবার্ট ব্রুস ও তার ভাই (১৮৩১) চার্লস নিশ্চিত করেন যে আসাম এলাকায় স্থানীয় চা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন সম্ভব এবং এই লক্ষে তারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে চায়ের বীজ এবং নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠান। ১৮৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লর্ড বেন্টিংক 'চা কমিটি' গঠন করেন। কমিটির সেক্রেটারি জি আই গর্ডঙ্কে চীনে পাঠিয়ে চা বীজ আনার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৩৫ সালে প্রথম ইন্ডিয়ান টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম দেয়া হয় 'আসাম টি কোম্পানি'। ১৮৩৬ সালে ব্রুসকে চা বাগানের অধীক্ষক নিযুক্ত করা হয়। চার্লস ব্রুস পৃথিবীর প্রথম পেশাদার টি প্লান্টার হিসেবে খ্যাতি অ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৮৫০ সালে দার্জিলিং এ চায়ের আবাদ শুরু হয়। ১৮৩৯ সালে বেঙ্গল টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা কর হয় কলকাতায়।
বাংলাদেশে চায়ের ইতিহাসঃ
বাংলাদেশের চা বাগানসমূহের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের। আসাম এবং তার আশপাশে চা চাষের উদ্যোগ বর্তমান বাংলাদেশেও সম্প্রসারিত হয়। তবে আসামে চা চাষের আগেও বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে চা চাষের উদ্যোগের কথা জানা যায়। ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামের কোদালা চা বাগানে জন্য জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরে বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব যেখানে অবস্থিত সেখানে প্রথম পরীক্ষামূলক চা গাছ রোপন করা হয়। এটি নাকি 'কুন্ডদের বাগান' নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব ভবন মূলত ছিল বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলো। বাগান টি লাভজনক হয়নি। বৃহৎপরিসরে বাগান হওয়ার আগেই তা পরিত্যক্ত হয়। বর্তমান সার্কিট হাউজ, জেলা জজের বাংলো, স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের পাহাড়ী এলাকা জুড়ে এই বাগান বিস্তৃত ছিল। ১৮২৮ সালে জায়গা বরাদ্ধ পেলেও চা বোর্ডের রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে কোদালা চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে এটি বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধীন বর্তমান বাংলাদেশের বহু এলাকায়ই পরীক্ষামূলক বাগান করেছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা ১৮৫৭ সালের পরবর্তীকালের ব্রিটিশ সরকার। ভারতীয় উপমহাদেশে যখন চায়ের আবাদ হয় সিলেট (শ্রীহট্ট) তখন আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আসামের অন্যান্য স্থানের মত সিলেটেও তখন চায়ের আবাদ শুরু হয়। সিলেট শহরের উপকন্ঠে ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ মালনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বাগানে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে এ দেশে চা একটি কৃষি ভিত্তিক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচাঁন্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। এরপর সিলেটে ও চট্টগামে চা বাগানের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চায়ের চাষ শুর হয় এবং ২০০৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বান্দরবানে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চায়ের চাষ শুর হয়। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমানে পঞ্চগড়ে একটি ও বান্দরবানে একটি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর উপকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদশে বর্তমানে ১৬২টি চা বাগান রয়েছে।
পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষের ইতিহাস
পঞ্চগড় জেলায় ১৯৯৯ ইং সালে চা চাষ করার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয় এবং সে মোতাবেক ২০০০ ইং সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড তথা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে পঞ্চগড়ে সর্বপ্রথম কাজী এন্ড কাজী চা বাগান ৬২৭.০০ একর জমিতে অর্গানিক চা চাষ শুরু করে যা পরবর্তীতে মীনা চা নামে পরিচিতি লাভ করে । এর পাশাপাশি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) পঞ্চগড় জেলায় ২০০১ ইং সালে একটি উপকেন্দ্র স্থাপন করে । বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড় জেলায় সর্বপ্রথম ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ শুরু করেন জনাব মোঃ মতিয়ার রহমান, জনাব মোঃ সিরাজুল ইসলাম, জনাব মোঃ ইসহাক আলী মণ্ডল, জনাব মোঃ আঃ রহমান এবং জনাব মোঃ আবুল হোসেন। তাঁরা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে সর্বপ্রথমে নিজস্ব চা নার্সারি তৈরি করেন এবং সেখানকার উৎপাদিত চা চারা দিয়ে মাঠ পর্যায়ে চা চাষ শুরু করেন । এতে স্থানীয় অন্যান্য চাষিরা উৎসাহিত হয়ে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর কারিগরি সহায়তায় চা চাষ শুরু করেন যা ২০০২ ইং সালে ১৮৪.২১ হেঃ জমির চা আবাদিতে পরিণত হয় । এভাবে পর্যায়ক্রমে পঞ্চগড়ে চা আবাদি দ্বারায় ২০০৩ ইং সালে = ৩৪২.১৯ হেঃ জমিতে এতে চা আবাদি জমির বৃদ্ধির পরিমান ২০০২ ইং সালের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ৩৪৭.৯৭ হেঃ । পরবর্তীতে, ২০০৪ ইং সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চাষি ১৭৮ জন, মাঝারি ১০ জন, টি এস্টেট এর সংখ্যা ছিল ০৬ টি এবং তাঁদের চা আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৪,১৫৩.৬৫ একর ও রোপিত চা আবাদির পরিমাণ ছিল ১১৩৮.৪৮ একর।
পঞ্চগড় এ চা চাষের যে বিপ্লব ঘটেছে তা মূলত বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এ নিয়োজিত বিজ্ঞানীদের নিরলশ কর্ম প্রচেষ্টায়। যার ফলে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের এই অবহেলিত অঞ্চল মঙ্গা নামক অভিশাপ্ত শব্দটিকে জয় করতে পেরেছে। এতে করে এই উত্তরের জনপদটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে তেমনি এই অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবে অন্যতম চালিকা শক্তিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। পঞ্চগড়ের এই ক্ষুদ্র পর্যায়ের চা চাষকে আরও বিকাশিত ও ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) সাম্প্রতি পঞ্চগড়ের চা চাষিদের মাঝে বিনামূল্যে সিএফসি প্রকল্পের মাধ্যমে চার লক্ষ চা চারা বিতরণ করেছে। যা নিঃসন্দেহে অত্যান্ত প্রশংসনীয়। তাছাড়াও প্রতি বছরই বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা পঞ্চগড়ের চা চাষিদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক পন্থায় চা চাষের কলাকৌশল হাতে কলমে শেখানোর জন্য বিভিন্ন প্রকারের প্রশিক্ষনের আয়োজন করে থাকেন । এতে করে চা চাষিরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন তেমনি পঞ্চগড়ের চা চাষ আরও বেগমান হচ্ছে। ফলে এর উপকারিতা পঞ্চগড়ে চা চাষে জড়িত প্রত্যাক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ১২,০০০ লোক সহ হত দরিদ্র প্রায় ২,০০০ নারী ও পুরুষ সকলেই পাচ্ছে । সে কারনে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর এই উপকেন্দ্রটি পঞ্চগড়ের লোকজনদের নিকট চায়ের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ।
তখনও পঞ্চগড়ের চা চাষিরা তাঁদের চয়নকৃত সবুজ চা পাতা বট লিফ চা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা না থাকার দরুন বিক্রয় করতে পারত না। সে সময়ে পঞ্চগড়ে চায়ের উৎপাদনের ব্যাপকতা দেখে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এর আর্থিক সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড এর কারিগরি সহযোগিতায় তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি (টিটিসিএল) নামক বট লিফ চা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা ২০০৪ ইং সালে তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত হয় । এতে করে পঞ্চগড়ের চা চাষে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় । এরপর হতে চা চাষিরা তাঁদের চয়নকৃত সবুজ চা পাতা ২০০৫ ইং সাল হতে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি(টিটিসিএল) এর নিকট বিক্রয় করতে শুরু করে । ২০০৮ ইং সালে পঞ্চগড়ে চা চাষে ব্যাপক সারা পরে, যার ফলে এই বৎসরে আরও চা চাষি তথা চা আবাদি বৃদ্ধি পায় । স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় চা চাষিদের পক্ষ থেকে পঞ্চগড়ে আরও একটি বট লিফ চা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা স্থাপনের দাবি এসেছিল । যার প্রেক্ষিতে উক্ত চা বছরে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড়ে করতোয়া বট লিফ চা কারখানা স্থাপিত হয়। এর ফলে পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হয় । ২০১১ ইং সালে এ বৎসরে পঞ্চগড়ের চায়ের উৎপাদনের উপর লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড়ে আরও দুটি বট লিফ চা কারখানা গ্রীন কেয়ার এগ্রো লিমিঃ ও গ্রীন এনার্জি টি ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় । ২০১৩ ইং সালে পঞ্চগড়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শক্রমে নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ফ্যাক্টরি নামক আরও একটি বট লিফ চা কারখানা স্থাপিত হয় । ২০১৬ সালে ৯টি চা বাগানের ৭৯৮.৪৩ হেক্টর জমিতে ৫০,১৬,৩৫২ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়াও পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র টি এস্টেট, ক্ষুদ্রায়তন চা চাষি ও ক্ষুদ্র চা চাষিদের মোট ১০৪৬.৮৪ হেক্টর জমিতে ৯৫,৫৬,৫৮৫ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। পঞ্চগড়ে সর্বমোট ১৮৪৫.২৭ হেক্টর জমিতে ১,৪৫,৭২,৯৩৭ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৭টি ফ্যাক্টরীতে মোট ৩২,০৬,০৪৬ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে।
দিনাজপুরে চায়ের চাষ
ধানের জেলা দিনাজপুরে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে চা। চা চাষের এই সাফল্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ইউপির ঝলঝলি গ্রামের নজরুল ইসলাম তার এক একর জমিতে চা চাষ শুরু করেন। সফলতাও পেয়েছেন আশাতীত। জমি প্রস্তুত করে চারা রোপণে তার খরচ করেছে ৬০ হাজার টাকা। আর গত বছরের আগস্টে চারা রোপণ করে এরই মধ্যে ৪ বার চা পাতা তুলেছেন। ২৫-২৬ টাকা কেজি দরে প্রায় ২৪ হাজার টাকার চা পাতাও বিক্রি করেছেন তিনি। গাছের বয়স ২ বছর হওয়ার পর প্রতি মাসে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকার চা পাতা বিক্রি করা যাবে বলে তিনি জানান। নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, চা গাছের গোড়ায় পানি না জমে সেজন্য জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোদে ছায়া দিতে চা গাছের মাঝে মাঝে নিমগাছ লাগিয়েছি। খরার সময় পাইপের সাহায্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হয় গাছে। বছরে ২ বার সার ব্যবহার করলেই চলে। আমি জৈব সার বেশি ব্যবহার করি। পলাশবাড়ী ঝলঝলি বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, পঞ্চগড়ের সাকোয়ার চা চারা বিক্রিকারী নার্সারির শরীফের পরামর্শে এবং চা বাগান করার নিজ আগ্রহে এ চা চাষ শুরু করি। পলাশবাড়ী ঝলঝলি বহুমুখী সমবায় সমিতির সহযোগিতায় গত বছরের আগস্টে চা চারা রোপণ করি। এরই মধ্যে চারবার চা পাতা সংগ্রহ করে পঞ্চগড় নর্থ বেঙ্গল চা কারখানায় বিক্রি করেছি। গাছের বয়স বাড়বে সঙ্গে চা পাতা সংগ্রহের পরিমাণও বাড়বে। হিমালয়ের পাদদেশে দিনাজপুরের অবস্থান হওয়ায় এ এলাকার চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া উপযুক্ত থাকায় এ উপজেলায় চা ভাল উৎপাদন হওয়া সম্ভব। চা গাছে নিবিড় পরিচর্যা, পরিমিত পানি সেচ, যত্নবান হতে হবে।
ঠাকুরগাঁও এ চায়ের চাষঃ
ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রথম চা চাষ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় কানিজ ফাতেমা ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নিটোলডোবা গ্রামে নাগর নদীর তীরে ২৫ একর জমির উপর একটি চা বাগান গড়ে তোলেন। পরে এই বাগানটি তিনি বিক্রি করে দেন গ্রীণফিল্ড টি এস্টেট কোম্পানির কাছে। গ্রীণফিল্ড টি এস্টেট বাগানটি সম্প্রসারিত করে মোট ৪৫ একর জমির উপর চা বাগান গড়ে তোলে। ঐ এলাকার ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা আরও ৪০ একর জমিতে ক্ষুদ্র পরিসরে চা বাগান গড়ে তুলেছেন। এর পর বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর এলাকার এমপি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আলহাজ্জ দবিরুল ইসলাম রনবাগ টি এস্টেট লিঃ নামে ২ বছর আগে দুটি চা বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এই প্রতিনিধি সম্প্রতি আলহাজ্জ দবিরুল ইসলামের চা বাগান পরিদর্শনে গেলে তিনি জানান, বাগান দুটি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিমি দূরে নদী নাগরের তীরে পাড়িয়া এলাকার রনবাগ এবং লাহিড়ী এলাকার পঞ্চুরহাট গ্রামে । রনবাগ গ্রামে জমির পরিমাণ ২৭০ বিঘা আর পঞ্চুরহাট গ্রামে জমির পরিমাণ ৪৫০ বিঘা । দবিরুল ইসলাম আরও জানান, চা চারা লাগানোর এক বছর পরই তিনি গত বছর ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে ৪ লক্ষ টাকার চা পাতা পঞ্চগড়ের করোতোয়া টি ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করেন। এবার তিনি দুটি বাগান থেকে ২০ লক্ষ টাকার চা পাতা বিক্রি করার আশা করেন। পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকায় বড় বড় চা বাগান গড়ে ওঠার পাশাপাশি প্রান্তিক চাষিরাও চা চাষ শুরু করেছেন। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নিটোলডোবা গ্রামের ৩৩ জন প্রান্তিক চাষি ৪০ একর জমিতে ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষ শুরু করেছেন। বর্তমানে ক্ষুদ্র চা চাষি রয়েছে ১২০ জন। তাদের সম্মিলিত জমির পরিমান পার্য ২০০ একর। বছরে প্রায় ৩ লাখ কেজি চা ক্ষুদ্র চা চাষিদের বাগান থেকে আহরিত হচ্ছে। ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় এলাকায় বড় পরিসরে এবং বিশেষ করে ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষের প্রচুর সম্ভাবনা বিরাজ করছে । চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে একদিকে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে অন্যদিকে উদ্বৃত্ত চা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
রংপুরে চায়ের চাষ
ঢাকা-রংপুরের মহাসড়ক ধরে উত্তরের সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার সময় পথের দু’ধারে দেখা মিলবে সারি সারি চা বাগান। চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজের সমারোহ এ বাগানগুলো দেখে। মনে হবে যেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং কিংবা শিলিগুড়ির পথে চলছি। সমতল জমিতে সারি সারি বাগানে চা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রমিকরা। মঙ্গা অঞ্চল নামে পরিচিত রংপুরে এখন উজ্জ্বল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে চা চাষ। এ অঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন প্রচুর চা চাষাবাদ হচ্ছে। অর্থকরী এ ফসল উৎপাদনে কৃষক পরিবারগুলোর মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। চা চাষের এ দৃশ্য এখন রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় চোখে পড়ে। প্রায় এক দশক আগে ব্যাপকহারে সীমান্তবর্তী পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় চা চাষ শুরু হয়। এখন তা সম্প্রসারিত হচ্ছে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। তাই এ অঞ্চলে চা চাষে সরকারি উদ্যোগ ও নজরদারী রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা নামের কলঙ্কমোচনে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা রাখছে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা চত্বর থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে রংপুর-দিনাজপুর হাইওয়ের সঙ্গে তারাগঞ্জ হাট। তার কিছু দূরে বাহাগিলী নামের একটি গ্রামের। বছর দুয়েক আগেও এ গ্রামের মাঠে শোভা পেত আলু আর তামাকের গাছ। এ বছর আলু আর তামাকের জায়গা দখল করে নিয়েছে চা বাগান। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ ও জলঢাকা এবং রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী তিনটি গ্রামের ৩০ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। সিনহা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এসব চা বাগানের মালিক। প্রতিষ্ঠানটির ইনচার্জ নওফেল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ১১ একর জমিতে চা বাগান করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ বাহাগিলিতে ৭ একর, দক্ষিণ দুরাকুটি গ্রামে ২ একর ও ইকরচালী ইউনিয়নের বরাতিতে ২ একর। ২০১৫ সালের ২ জুন এখানে চারা লাগানো হয়। চলতি বছরের জুলাই থেকে পাতা তোলা শুরু হয়েছে। এখন তা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে প্রায় ৩০ একরে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখানকার জমি উর্বর। চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আবহাওয়াও অনুকূল। সাধারণত চারা লাগানোর পর ৩-৪ বছর লাগে প্রোডাকশনে যেতে। অথচ এখানে আমরা এক বছরের মাথায় প্রোডাকশন শুরু করেছি, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, প্রতি ২০ দিন পর পর পাতা তুলে পঞ্চগড়ে বিক্রি করা হয়। ১১ একরের এ বাগান থেকে প্রতি চালানে ২৫ হাজার কেজি পাতা তোলা হচ্ছে। প্রতি কেজি পাতা ২৩ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে যতই দিন যাচ্ছে উৎপাদন ততই বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি চালানে উৎপাদন খরচ মিটিয়ে ১২-১৫ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। গাছের বয়স ২-৩ বছর হলে উৎপাদন অনেক বাড়বে কিন্তু উৎপাদন খরচ অনেক কমবে। তখন অনেক বেশি লাভ হবে। তিনি জানান, আগামী দু’এক বছরের মধ্যে ১০০ একর জমিতে চা বাগান করা এবং চা তৈরির কারখানা স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং এ এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যাবে।এ বাগানের ম্যানেজার রিফাত আনোয়ার বলেন, বর্তমানে বাগানে প্রতিদিন ২৫-৩০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তবে পাতা তোলার দিন ৪০-৫০ জন কর্মী লাগে। এ শ্রমিকদের অধিকাংশ স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা ও অসহায় নারী। তিনি জানান, এখানে টিভি-২৫-২৬, বিটি-২ এবং টিভি-২৩ জাতের চা লাগানো হয়েছে। এখানকার চায়ে ফাইবার কম, গ্রিন লিফ বেশি।
লালমনিরহাটে চা চাষ
সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের চাষ হয় হাতীবান্ধা উপজেলার পূর্ব বিছনদই এলাকায়। ওই গ্রামের ফেরদৌসের স্ত্রী শাহানারা বেগম সোমা জীবিকার সন্ধানে একটি এনজিও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন চায়ের এলাকা পঞ্চগড় জেলায়। সেখানকার চা বাগান মালিকদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখে নিজেও শখ করে চা গাছের চারা নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় রোপন করেন সোমা। সেই চায়ের গাছটি দিনে দিনে বড় হলে সোমার চা শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্নটাও বড় হতে থাকে। আস্তে আস্তে তিনি নিজ বাড়ির উঠানে গড়ে তোলেন চায়ের বাগান। এনজিওর চাকরি ছেড়ে দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে নিজের চা বাগানের পরিচর্যায় মনোযোগ দেন সোমা ও তার স্বামী ফেরদৌস আলম। এভাবেই শুরু। তারপরের ঘটনা এলাকার প্রায় সবারই জানা। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্থানীয় চা বাগান মালিক সেই সোমার সাথে যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠে সোমা এন্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের চা বাগানের স্বপ্নদ্রষ্টা শাহানা বেগম সোমা জানান, প্রথম দিকে অনেকটা শখ করেই চা বাগান শুরু করেন। সেই শখই একদিন চা শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্নকে লালন করেই সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি। চা শিল্প পুরোপুরি বিকাশ ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে লালমনিরহাটের চা। একইসঙ্গে জেলাবাসীর আর্থসামাজিক অবস্থারও ইতবাচক পরিবর্তন ঘটবে বলেও আশা করেন তিনি। সোমা দম্পতির একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা চা বাগান দেখে এ অঞ্চলের অনেকেই চা বাগান করায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এসব আগ্রহী চাষিদের সুবিধার জন্য এ দম্পতি পরবর্তীতে গড়ে তোলেন দু’টি চা গাছের নার্সারি। সেখান থেকে সুলভ মূল্যে চারা সংগ্রহ করে এখন অনেক কৃষকই গড়ে তুলেছেন চা বাগান। নতুন আরও অনেকেই এগিয়ে আসছেন চা বাগান করার পরিকল্পনা নিয়ে। হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়ার চা বাগান মালিক বদিউজ্জামান ভেলু বলেন, চা বাগানে একবার চারা রোপন করে পরিচর্যা করলেই কম খরচে অনেক মুনাফা পাওয়া যায়। তাই তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ২ একর জমিতে চা বাগান করেছি। পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা জমগ্রামের চাষী তাজুল ইসলাম ও দহগ্রামের চাষী বেলাল হোসেন বলেন, স্বল্প পরিশ্রমে ও কম খরচে অধিক মুনাফা পেতে চা চাষের বিকল্প নেই। বর্তমানে নিজ জেলায় টি প্রসেসিং কোম্পানি হওয়ায় বিক্রি করতেও ঝামেলা নেই। তাই দিন দিন এ জেলায় চা চাষীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও মনে করেন তারা। চা শিল্পের প্রসারে লালমনিরহাটে একটি চা বোর্ড গঠনের দাবি জানান এ দুই চা চাষী। বর্তমানে সীমান্তবর্তী এ জেলার ৫টি উপজেলায় দুইশ একর জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগান। নতুন করে ৫শ একর জমিতে চা বাগান করার প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানান সোমা টি প্রসেসিং লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস আলম। তিনি বলেন, এসব বাগানের পাতা সংগ্রহ ও পরিচর্যা করে গ্রামীণ অনেক নারী পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীণ বেকার জনগোষ্ঠীর কাজের সুযোগ তৈরী হওয়ায় নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন ব্যাপক অবদান। ফেরদৌস আলম জানান, এ অঞ্চলে প্রতি একর জমিতে চা উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭ মেট্রিক টন। সে অনুযায়ী বর্তমানে ২শত একর জমিতে মোট এক হাজার চার শত মেট্রিক টন চা উৎপান হচ্ছে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায়। ২শ একর জমির চা চাষী ৭৫জন। সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস আলম আরও জানান, প্রথম দিকে এ অঞ্চলের চাষীদের উৎপাদিত চা পাতা বিক্রি হত পঞ্চগড় জেলায়। দূরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে চার্ষীদের পরিবহন খরচ মেটানোর পর তেমন একটা মুনাফা হত না। তাই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চুক্তি করে যৌথ উদ্যোগে নিজ গ্রামে গড়ে তুলেন সোমা এন্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে চা পাতা সোধনাগার। যার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের নভেম্বরে। বর্তমানে এ অঞ্চলের চাষীরা প্রতি কেজি ১৮টাকা দরে সোমা টি প্রসেসিং এ কাঁচা চা পাতা সরবরাহ করছেন। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের জটিলতার কারণে সংযোগ না পাওয়ায় জেনারেটর দিয়েই চালু করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, দেশে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রাধিকার প্রকল্প সোমা এন্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড। যা বিদ্যুতের অভাবে অধিক ব্যয়ে জেনারেটর দিয়ে চালু করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার কারণে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। চা শিল্পের জন্য যথেষ্ট উপযোগী দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তি জেলা লালমনিরহাট। আর এ জেলার চা শিল্পের প্রসার ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন এ শিল্পের সাথে জড়িতরা।
নীলফামারীতে চায়ের চাষ
কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বর প্রায় ২২ একর জমি নিয়ে অবস্থিত। পতিত জমিগুলো ব্যবহারের লক্ষ্যে পঞ্চগড়ে চা বোর্ডের কর্মরত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে প্রথমে মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায় এ এলাকার মাটি চা চাষের উপযোগি। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান সৃস্টি ও উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে ১ বিঘা জমিতে প্রায় ২ হাজার চা চারা রোপন করে চা চাষ করে আশাতিত ফল পায়। চা চারা রোপনের অল্প দিনে চা গাছ গজাতে শুরু করে। পরবর্তীতে আরো চারা এনে উপজেলা পরিষদের পতিত প্রায় সাড়ে ৪ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। চা চাষ বৃদ্ধির লক্ষে সিনহা কোম্পানীর পতিত জমিতে চা চাষের জন্য উদ্বুদ্ধকরণের ফলে তারাও তাদের পতিত প্রায় ৯ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। উপজেলার কেশবা গুচ্ছগ্রাম সংলগ্ন পতিত প্রায় ৩ একর জমিতে করা হয়েছে চা চাষ। এছাড়া চাষ করা হয়েছে মাগুড়া ইউনিয়নে তহশিল অফিসের ১ বিঘা ও উপজেলা ভূমি অফিসের ১৫ শতাংশ পতিত জমিতে। চা চাষের সাফল্য দেখে এ এলাকার কৃষকদের বিষবৃক্ষ তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শুরু যেভাবেঃ নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ না থাকায় উপজেলার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকটসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে কি করে খাবে এ কথা ব্যক্ত করতেন। এসব ব্যক্তির কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তে ও জেলা প্রশাসনের পরামর্শে পরিষদের পতিত জমিতে চা চাষ শুরু করে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিঃ চা বাগান গুলো পুনর্বাসিত -দরিদ্রদের কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ এসে যদি বলতো কি করে খাবো তাকে ঘন্টা প্রতি ২০ টাকা করে শ্রমের মূল্য দিয়ে বাগানে কাজ করানো জন্য লাগানো হয়। দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করে ১৬০ টাকা করে পারিশ্রমিক পায়। চা বাগানের ফলে অলস হাত গুলো কর্মের হাতে পরিণত হয়েছে। ফলে ওই পরিবারগুলোতে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সৃজিত বাগানগুলোতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ জনের কর্মসংস্থান সৃস্টি হয়েছে।
উন্নয়নের প্রতীকি ফসলঃ চা একটি অভিজাত ও দীর্ঘজীবি ফসল। চা চারা একবার রোপন করলে আনুমানিক ৭০ বছর কমপক্ষে ৫০ বছর উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। বানিজ্যিকভাবে ৫০ বছর পাতা উত্তোলন করা যায়। চা চারা রোপনের ৩ বছর পর থেকে প্রতি বছরে একরে আনুমানিক ২ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকার পাতা উত্তোলন হয়। খরচ যেয়ে বছর ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা লাভ হয়। যা অন্যান্য ফসল থেকে আসে না। এছাড়া অন্যান্য ফসলে কোন বছরে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পারে আবার কোন বছর লোকসান হয়। সেখানে চা চাষ প্রতি বছর একরে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা লাভ দেয়। অন্যদিকে যে জমিতে কোন ফসল হয় না অথবা দিনের পর দিন পরে থাকতো এরকম পতিত জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে চা গাছ। লোকসান বিহীন ফসলের চাষ, পতিত জমিগুলো ব্যবহার আর কর্মসংস্থান সৃস্টি হওয়ায় চা চাষ উন্নয়নের প্রতীকি ফসলের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তামাকের পরিবর্তে চা চাষঃ বিষবৃক্ষ তামাক চাষ খ্যাত এলাকা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলা। তামাক চাষের ফলে এলাকার ধানসহ বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চলে যাচ্ছে তামাক চাষের কবলে। এতে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। তামাক চাষের ফলে তামাক চাষী, পরিবারের সদস্য ও পার্শ্ববর্তী লোকজনের স্বাস্থ্যহানিসহ নানা রকম রোগে ভুগতে থাকে। তামাক চাষ ক্ষতিকারক বুঝতে পেরে কৃষকরা তামাক চাষের পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব চা চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। এ ফসল এ এলাকার জন্য তামাকের বিকল্প ফসলে রুপান্তর হবে এমটাই ভাবছে অনেকে।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণঃ চা চারা রোপনের ১ বছর ৬ মাস থেকে চা পাতা উত্তোলন যোগ্য হওয়ায় তা তুলে সনাতন পদ্ধতিতে চা তৈরি করা শুরু হয়েছে। কাচাঁ পাতা উত্তোলন করে প্রথমে বাছাই করা হয়। এর কাঁচা পাতা ঢেঁকি দিয়ে পিসিয়ে তা ভাজা হয়। ভাজা চা পাতার গুরাগুলো পরিস্কার করে চা তৈরি করা হয়। তাজা পাতা তাজা খ্রান সমৃদ্ধ চা প্যাকেটজাত করে স্থানীয় বাজারে কেজি প্রতি ৩ শত টাকা বিক্রি শুরু হয়েছে।
কাইজেন টিঃ স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত চায়ের নাম দেয়া হয়েছে কাইজেন টি। কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন অফিসসহ বাজারের দোকানগুলোতে কাইজেন টি বাজারজাত শুরু হওয়ায় এলাকার মানুষজন তা কিনে খাচ্ছে। এর কদরও দিন দিন বাড়ছে। তাজা পাতার তাজা চায়ের স্বাদে এলাকার মানুষ এ চা দিব্বি কিনছে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে চলতি বছরে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ১ লক্ষ্য চা চারা রোপনের জন্য বিতরণ করার টার্গেট নেয়া হয়েছে। উপজেলা পরিষদে সরকারীভাবে চা নার্সারী তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। এছাড়া আগামী ২০২০ সালের মধ্যে নীলফামারী জেলায় ২৫ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ডের। তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে চা চাষে বাংলাদেশ চা বোর্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৬ জন তামাক চাষী চা চাষের জন্য নিবন্ধন করেছে বলেও চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে তথ্য অনুসারে জানা গেছে যে, চা চাষের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আনুমানিক ৫০ জন পুনর্বাসিত ভিক্ষুকের কর্মসংস্থান সৃস্টি হয়েছে। তাছাড়া তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে চা চাষে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন তামাক চাষী চা চাষের অভিমত ব্যক্ত করেছে ও নিবন্ধনও করেছেন। পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান, কিশোরগঞ্জ উপজেলার আর্থিক উন্নয়ন ও উপজেলা পরিষদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে চা চাষ শুরু করা হয়েছে। চা বাগানের নাম কাইজেন টি গার্ডেন রাখার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তিনি জানান- কাইজেন জাপানী শব্দ। কাই শব্দের অর্থ- ছোট আকারে পরিবর্তন আর জেন শব্দের অর্থ- ভালো। এককথায় কাইজেন শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে ভালোর জন্য পরিবর্তন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জানান- চা চাষ একদিকে যেমন উপজেলা পরিষদের রাজস্ব বৃদ্ধি করবে অন্যদিকে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃস্টি হবে। আমাদের চা চাষে সাফল্য দেখে অনেক কৃষক তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এছাড়া চা চাষে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। চা চাষের ফলে এ উপজেলার আমুল উন্নতি হবে।
বান্দরবানে চা চাষ
চা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে। পার্বত্য জেলাগুলোতে ক্ষুদ্রাতায়নে চা চাষ করা হলে এখানকার দারিদ্র বিমোচন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসায়িক যোগাযোগসহ দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির পাহাড়ী এলাকা চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ২০০৩ সালে তিন পার্বত্য জেলায় প্রথম পর্যায়ে ৩০০ হেক্টর জমিতে চা চাষের পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্পের আওতায় বান্দরবানে ২০০৫ সাল থেকে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ প্রকল্পের আওতায় ৩৩০ জন ক্ষুদ্রায়তন চা চাষির ৫১৬ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা ও বান্দরবান সদর উপজেলায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ক্ষুদ্র চাষিরা চা চাষ করেছেন। তবে প্রকল্পের আওতায় রুমা উপজেলায় ৯৬ পরিবারে, বান্দরবান সদর উপজেলায় ৬০ পরিবারে এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৩৯ পরিবারে অর্থাৎ মোট ১৯৫ পরিবারে ৬ লাখ ৭ হাজার ৪ দশত চা চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। পাহাড়ে কৃষকেরা ধীরে ধীরে চা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে নতুন চা কারখানা স্থাপিত হওয়ায় বান্দরবানের নতুন চায়ের ব্র্যান্ড বাজারে আসবে। এই চা হবে গুণে ও মানে উৎকৃষ্ট। এছাড়াও কক্সবাজার জেলায় ২ হাজার ২৮০ হেক্টর জমি রয়েছে। তবে অজ্ঞাত কারণে কক্সবাজারে এখনও চা উৎপাদর শুরু হয়নি। হয়ত অচিরেই এ জেলায়ও শুরু হবে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ। চা চাষের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব।
বৃহদায়তন চা বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সৃজনের মাধ্যমে দেশের চা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি জেলায় ৫০ হেক্টর, খাগড়াছড়ি জেলায় ২৫ হেক্টর এবং বান্দরবান জেলায় ২২৫ হেক্টরসহ তিন পাবর্ত্য জেলায় ৩০০ হেক্টর এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১০২৯.৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে আগস্ট ২০০৩ হতে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য ‘স্মল হোল্ডিং টি কালটিভেশন ইন চিটাগাং হিল ট্রাক্টস’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেয়া হয়। উক্ত প্রকল্পের আওতায় ৫২ জন স্মল গ্রোয়ার্স/হোল্ডার এ পর্যন্ত বান্দরবানে ১১০ হেক্টর, মানিকছড়িতে ৩.২০ হেক্টর এবং রাঙ্গামাটিতে ১.৮২ হেক্টর অর্থাৎ মোট ১১৫.০২ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনয়ন করেছে। বান্দরবান জেলার স্মল গ্রোয়ার্সদের সংঘটিত করার জন্য ইতোমধ্যে একটি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। উক্ত এলাকায় ২০১০ সালে চা পাতা চয়ন শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে ৩১,০০০ কেজি সবুজ চা পাতা চয়ন করা হয়েছে, তা থেকে ৫,৭৮৫ কেজি মেইড টি তৈরী হয়েছে। বান্দরবানে উৎপাদিত ক্লোন চা এখন চট্টগ্রাম নিলামে উচ্চমূল্যে বিক্রয় হচ্ছে যা ক্রেতা জনসাধারণের নিকট সমাদৃত হয়েছে।
দেশের পঞ্চগড় ও পার্বত্য বান্দরবান জেলায় খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর সিএফসি অর্থায়নে ১টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষীদের চা চাষে প্রশিক্ষণ প্রদান, ১০.০০ লক্ষ চা চারা উত্তোলন পূর্বক ক্ষুদ্র চাষীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ এবং ১০টি সবুজ চা পাতা সংগ্রহ কেন্দ্র ও ১০টি সমবায় কেন্দ্র স্থাপন, ২টি পিকআপ, ৩টি লাইট ট্রাক, ৩টি মোটর সাইকেল ক্রয়, প্রভৃতি কাজ অন্তর্ভুক্ত করে সিএফসি অর্থায়নে একটি প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড।
ময়মনসিংহে চায়ের চাষ
সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ের পরে এবার গারো পাহাড়ের পাদদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল জেলায় চায়ের আবাদ শুরু হচ্ছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড গারো পাহাড়ের পাদদেশে অনুর্বর টিলায় চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করে এ অঞ্চলে চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে। তবে উদ্যোক্তা, জমি এবং অর্থায়নের অভাবে তখন সেখানে আর চা চাষ হয়নি। গারো হিলস টি কোম্পানি নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীতে গারো ও হাজং জাতিসত্তা অধ্যুষিত এলাকায় এ চাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। ২০১৭ সালে ১৩ জন স্থানীয় কৃষককে তিনি পঞ্চগড়ে চা চাষ দেখতে পাঠান। এরপর গত বছরের এপ্রিল মাসে তিন উপজেলার ২৬ জন কৃষক এ চাষ শুরু করেন। চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে এখন শতাধিক কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানান কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা জনাব আমজাদ হোসেন। তিনি দুই লাখ চারা দিয়ে একটি নার্সারি তৈরি করেছেন। এখন শেরপুরের তিন উপজেলায় ক্ষুদ্র চা চাষি উন্নয়ন কমিটি তৈরি করা হয়েছে। ২৬ জন্য সদস্য আছেন কমিটিতে। আরও ৯৮ জন নতুন সদস্য প্রক্রিয়াধীন। বর্তমানে ২৪ জন ক্ষুদ্র চা চাষি ৫.৩১ একর জমিতে চা চাষ করছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক বৃহত্তর ময়মনসিংহে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প গ্রহণের নিমিত্তে পুনরায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। উক্ত যাচাই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহে জেলাসমূহে মোট ১৩,৬৪৫ একর জমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ সম্ভব। ক্ষুদ্র আকারে চা চাষ জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ এখান থেকে দ্রুত এবং স্থায়ী আয় হয়। এখন দেশের ভবিষ্যৎ এই সীমিত আকারের চায়ের চাষে। কারণ, যে হারে চায়ের চাহিদা বাড়ছে তাতে এই ধারার চায়ের আবাদের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ চা বোর্ডের লক্ষ্য ২০২০ সালে ১ কোটি কেজি চা ক্ষুদ্র খাত থেকে উৎপাদন করা। আর ২০৩০ সালে তা হবে ৩ কোটি কেজি চা। ওই সময় দেশের মোট চা উৎপাদন হবে ১৪ কোটি কেজি এবং চাহিদা থাকবে ১৩ কোটি কেজি। এর মধ্যে ৩ কোটি কেজি আসবে ক্ষুদ্র পরিসর থেকে। কেবল ১০ জেলায় নয়, দেশের ২৫ জেলায় ক্ষুদ্র আকারে চায়ের আবাদ সম্ভব।
চীনের একটি উপজাতীয় ভাষা অময় (Amoy)। এই অময় ভাহসার শব্দ 'তে' (te) থেকে পরর্বর্তীতে ক্যান্টনিজ ভাষায় চা (Cha) শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে বলে জানা যায়। চা শব্দটি পারস্য, পর্তুগীজ, জাপান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভাষায় সাদরে গৃহীত হয়েছে। তবে 'তে' (te) নামটি থেকে আরেকটি অপভ্রংশ 'Tea' ইংরেজি ভাষা প্রভাবিত বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজরা এ উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করার পূর্বেই ফারসি ভাষার অন্যান্য শব্দের সাথে 'চা' শব্দটি বাংলা ভাষায় স্থাপন করে নেয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, 'চা' শব্দটি সরাসরি চীন থেকে এ উপমহাদেশে আসেনি, এসেছে ফারসি ভাষা থেকে।
চায়ের পরিবেশঃ
ভূমি, জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ চায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চা গাছ এমন একটি কৃষিজাত ফসল যে তার বৃদ্ধিতে কিছুটা আরণ্যক পরিবেশ পছন্দ করে। উষ্ণ অ আদ্র পরিবেশ যেখানে তাপমাত্রা ২৬°-২৮° সেঃ এবং বৃষ্টিপাত ২০০০ মিমি এর উপরে ও বাতাসে জলীয় অংশ অর্থাৎ ৭০-৯০%, সে জায়গা চায়ের বৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ। এছাড়া দিবালোকের স্থায়িত্ব ১২ ঘন্টার কাছাকাছি, মাটি অম্লধর্মী (পিএইচ ৪.৫ থেকে ৫.৮), বেলে-দোয়াশ ও সন্তোষজনক পুষ্টিমানসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। চা গাছ মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে নে। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি কোনটাই চায়ের অনুকূল নয়। প্রচুর পানি যেমন দরকার তেমনই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও নিশ্চিত থাকা জরুরী।
চায়ের উদ্ভিদতত্ত্ব
চায়ের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Camellia sinensis L. সকল চা গাছ একই প্রজাতিভূক্ত। ১৭৫৭ সালে সুইডিশ উদ্ভিদ শ্রেণিতত্ত্ববিদ ক্যারোলাস লিনিয়াস তার প্রকাশিত Species Plantraum নামের বইয়ের প্রথম খন্ডের ৫১৫ পৃষ্ঠায় চা কে Camellia sinensis হিসাবে তালিকাভুক্ত করেন। একই বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে তিনি শোভাবর্ধক চায়ের আরেকটি জাতকে Camellia japonica নামে অভিহিত করেন। Thea এবং Camellia প্রথম দিকে আলাদা Genus হলেও পরবর্তী সময়ে Thea জেনাসে চা কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। Thea একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ দেবী। সেই হিসাবে চা কে ঐশ্বরিক গুল্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৮১৮ সালে ইংরেজ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট সুইট এবং ১৮২২ সালে প্রকৃতি বিজ্ঞানী হেনরিক ফেডারিক চা কে Thea জেনাসের পরিবর্তে Camellia জেনাসে এর অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে বর্তমানে বাংলাদেশে চায়ের দু'টি প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে আবাদ করা হয়। তন্মধ্যে একটি Camellia sinensis এবং অপরটি Camellia assamica.
উদ্ভিদ উৎপত্তি বিশারদগণ বলেছেন চায়ের উৎপত্তিস্থল বা আদিবাস বর্তমান সুদূর উত্তর চীন ও মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে। কিন্তু এর বিস্তৃতি আজ উত্তর চীন থেকে দক্ষিণ আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। বাহ্যিক গঠনভেদে চা গাছ প্রধানত দু'টি জাত বড় পাতাওয়ালা আসাম জাত ও ছোট পাতার চীনা জাতে ভাগ করা হয়। এছাড়া মাধ্যমিক গঠনের কয়েক প্রকার উপজাতেও শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। যেমন-মণিপুরী, বার্মা, হাইব্রিড ইত্যাদি।
চা গাছ ছেঁটে না রাখলে মাঠে ৩ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ছাটাইয়ের পরে নতুন গজান বিটপের অতি কোমল অংশ অর্থাৎ কুঁড়ি ও তার কিছু নিচ অবধি নরম ডগা থেকেই ভাল চা হয়। আর আদর্শ পরিবেশে একটি গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক চয়ন ৫০ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে। এরপর গাছ উৎপাদনক্ষম থাকলেও লাভজনক থাকে না। বরং তখন উহা উপড়ে ফেলে (uprooting) নতুন করে আবাদি করাই উত্তম।
চায়ের ইতিহাসঃ
চায়ের জন্ম সুদূর চীন দেশেই। যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও ২৭৩৭ বছর আগের কথা। সে সময়কার চীনের সম্রাট শেন নাং পানির সাথে চায়ের কয়েকটা পাতা মিশিয়ে পান করে গরম পানি পান করা অপেক্ষা কিছুটা ভিন্ন স্বাদ অনুভব করেন এবং সম্রাট শেন নাং চা’কে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দেন। সেই থেকেই আজও চা স্বাস্থ্যরক্ষায় ব্যবহার হয়ে আসছে। ঐ সময় শুধুমাত্র রাজা ও রাজপরিবার সদস্যবৃন্দ ঔষধ হিসেবে চায়ের আস্বাদন নিতে পারত। চা নিয়ে প্রচলিত একটি উপকথার কথাই বলা যাক। এক বনে এক সন্নাসী ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ তার খুব নিদ্রা পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই নিদ্রা দূর করতে পারছিল না। এতই ঘুম যে চোখের দুটি পাতা আপনিই ভারী হয়ে বুজে আসে। সাধনায় চোখের পাতা দুটি খুবই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। সন্নাসী রাগে চোখের পাতা দুটোকে ছিড়ে ফেলে দিল। চোখের পাতা ছেড়ার ব্যাথায় আপাতত ঘুম চলে গেল। যেখানে চোখের পাতা দুটি ফেলা হয়েছিল সেখানে মাটি ফুড়ে গজিয়ে গেল ছোট্ট একটি সুন্দর গাছ। সন্নাসী গাছটির পাতা ছিড়ে নিজের চোখের উপর রাখলেন কিন্তু পাতা দুটি তার চোখে জোড়া না লাগায় সন্নাসী ভীষন ক্ষেপে পাতা দুটি চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন। এতেই ঘটে গেল এক অলৌকিক কান্ড। সন্নাসীর নিদ্রা দূর হয়ে গেল। জানি এ শুধুই উপকথা। কিন্তু আজও যখন আমরা বলি চা খেলে ঘুম আসে না সেটাকি এই উপকথার সূত্র ধরেই। এটি প্রতীয়মান হয় যে চা শুধু ঔষধি পানীয়ই নয় এটা ক্লান্তি দূর করে ও শরীরকে চাঙ্গা করে। চা (ইংরেজি ‘টি’) শব্দটা এসেছে চীন দেশের ‘te’ থেকে। কম্বোডিয়া ভাষায় এর নাম ‘cha’ এবং ওই নাম নিয়েই সে বিশ্ব ভ্রমন করেছে, গেছে জাপান, ইরান, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং এসেছে আমাদের ভারতেবর্ষে।
চীনের পরে জাপানেই চা আবাদ শুরু হয়। ইসাঈ (১৪১১-১২১৫) নামের এক ধর্ম প্রচারক চীন থেকে জাপানে প্রথম চা বীজ নিয়ে যান এবং তাঁকেই জাপানের চা শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় চা প্রবর্তন করা হলেও বাণিজ্যিকভাবে চা আবাদ শুরু হয় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান থেকে বীজ বপন করে। পরে ১৮৭৮ সালে ভারতের আসাম থেকে বীজ দিয়ে চা আবাদ শুরু হলে ইন্দোনেশিয়াতে চা আবাদ লাভজনক হয়ে উঠে। ভারতের চা চাষের সফলতায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে অন্যান্য দেশেও চা চাষ আরম্ভ করে। শ্রীলঙ্কাতে কফি গাছে পাতার মোড়ক দেখা দিলে ১৮৭০ সনের পর শ্রীলঙ্কাতে কফি প্রতিস্থাপন করে ব্যাপকভাবে চা আবাদ আরম্ভ হয়। আফ্রিকার মালাউতে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। বিংশ শতাব্দীর কুড়ি এবং ত্রিশের দশকে কেনিয়া, তানজানিয়া এবং উগান্ডায় চা আবাদ শুরু হয়। ১৮৪৬ সালে রাশিয়াতে প্রথম চা রোপণ করা হলেও প্রথম সাফল্যজনক আবাদ জর্জিয়াতে শুরু হয় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া তাইওয়ানে ১৮১৫, তুরস্কে ১৮৩৯, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে চা প্রবর্তন করা হয়।
ভারত উপমহাদেশে চাঃ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানা কারণে চীন এবং পার্শববর্তী দেশগুলোয় বাণিজ্যিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। চা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই সমস্যায় পড়তে হয় কোম্পনীকে। তাই উনিশ শতকের শুরুতে কোম্পানীকে নতুন ভাবনায় পড়তে হয়। জন কোম্পানী অধিকৃত ভারতে চা চাষের নতুন সম্ভাবনার মধ্যে সমস্যাটির সমাধান খুজে পায়। আসামের জঙ্গলে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে মেজর স্কট এবং ক্যাপ্টেন সিএ ব্রুস বা লেঃ চার্ল্টন চা গাছ আবিষ্কার করেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম চীন থেকে চা বীজ আনা হয়য় বলে জানা যায়। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে জোসেফ ব্যাংক (উদ্ভিদতত্ত্ববিদ) হিমালয়ের পাদদেশে চা আবাদের সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন। তার প্রায় একশ বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী রবার্ট ব্রুস ও তার ভাই (১৮৩১) চার্লস নিশ্চিত করেন যে আসাম এলাকায় স্থানীয় চা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন সম্ভব এবং এই লক্ষে তারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে চায়ের বীজ এবং নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠান। ১৮৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লর্ড বেন্টিংক 'চা কমিটি' গঠন করেন। কমিটির সেক্রেটারি জি আই গর্ডঙ্কে চীনে পাঠিয়ে চা বীজ আনার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৩৫ সালে প্রথম ইন্ডিয়ান টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম দেয়া হয় 'আসাম টি কোম্পানি'। ১৮৩৬ সালে ব্রুসকে চা বাগানের অধীক্ষক নিযুক্ত করা হয়। চার্লস ব্রুস পৃথিবীর প্রথম পেশাদার টি প্লান্টার হিসেবে খ্যাতি অ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৮৫০ সালে দার্জিলিং এ চায়ের আবাদ শুরু হয়। ১৮৩৯ সালে বেঙ্গল টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা কর হয় কলকাতায়।
বাংলাদেশে চায়ের ইতিহাসঃ
বাংলাদেশের চা বাগানসমূহের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের। আসাম এবং তার আশপাশে চা চাষের উদ্যোগ বর্তমান বাংলাদেশেও সম্প্রসারিত হয়। তবে আসামে চা চাষের আগেও বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে চা চাষের উদ্যোগের কথা জানা যায়। ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামের কোদালা চা বাগানে জন্য জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরে বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব যেখানে অবস্থিত সেখানে প্রথম পরীক্ষামূলক চা গাছ রোপন করা হয়। এটি নাকি 'কুন্ডদের বাগান' নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব ভবন মূলত ছিল বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলো। বাগান টি লাভজনক হয়নি। বৃহৎপরিসরে বাগান হওয়ার আগেই তা পরিত্যক্ত হয়। বর্তমান সার্কিট হাউজ, জেলা জজের বাংলো, স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের পাহাড়ী এলাকা জুড়ে এই বাগান বিস্তৃত ছিল। ১৮২৮ সালে জায়গা বরাদ্ধ পেলেও চা বোর্ডের রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে কোদালা চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে এটি বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধীন বর্তমান বাংলাদেশের বহু এলাকায়ই পরীক্ষামূলক বাগান করেছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা ১৮৫৭ সালের পরবর্তীকালের ব্রিটিশ সরকার। ভারতীয় উপমহাদেশে যখন চায়ের আবাদ হয় সিলেট (শ্রীহট্ট) তখন আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আসামের অন্যান্য স্থানের মত সিলেটেও তখন চায়ের আবাদ শুরু হয়। সিলেট শহরের উপকন্ঠে ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ মালনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বাগানে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে এ দেশে চা একটি কৃষি ভিত্তিক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচাঁন্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। এরপর সিলেটে ও চট্টগামে চা বাগানের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চায়ের চাষ শুর হয় এবং ২০০৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বান্দরবানে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চায়ের চাষ শুর হয়। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমানে পঞ্চগড়ে একটি ও বান্দরবানে একটি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর উপকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদশে বর্তমানে ১৬২টি চা বাগান রয়েছে।
পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষের ইতিহাস
পঞ্চগড় জেলায় ১৯৯৯ ইং সালে চা চাষ করার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয় এবং সে মোতাবেক ২০০০ ইং সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড তথা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে পঞ্চগড়ে সর্বপ্রথম কাজী এন্ড কাজী চা বাগান ৬২৭.০০ একর জমিতে অর্গানিক চা চাষ শুরু করে যা পরবর্তীতে মীনা চা নামে পরিচিতি লাভ করে । এর পাশাপাশি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) পঞ্চগড় জেলায় ২০০১ ইং সালে একটি উপকেন্দ্র স্থাপন করে । বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড় জেলায় সর্বপ্রথম ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ শুরু করেন জনাব মোঃ মতিয়ার রহমান, জনাব মোঃ সিরাজুল ইসলাম, জনাব মোঃ ইসহাক আলী মণ্ডল, জনাব মোঃ আঃ রহমান এবং জনাব মোঃ আবুল হোসেন। তাঁরা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে সর্বপ্রথমে নিজস্ব চা নার্সারি তৈরি করেন এবং সেখানকার উৎপাদিত চা চারা দিয়ে মাঠ পর্যায়ে চা চাষ শুরু করেন । এতে স্থানীয় অন্যান্য চাষিরা উৎসাহিত হয়ে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর কারিগরি সহায়তায় চা চাষ শুরু করেন যা ২০০২ ইং সালে ১৮৪.২১ হেঃ জমির চা আবাদিতে পরিণত হয় । এভাবে পর্যায়ক্রমে পঞ্চগড়ে চা আবাদি দ্বারায় ২০০৩ ইং সালে = ৩৪২.১৯ হেঃ জমিতে এতে চা আবাদি জমির বৃদ্ধির পরিমান ২০০২ ইং সালের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ৩৪৭.৯৭ হেঃ । পরবর্তীতে, ২০০৪ ইং সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চাষি ১৭৮ জন, মাঝারি ১০ জন, টি এস্টেট এর সংখ্যা ছিল ০৬ টি এবং তাঁদের চা আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৪,১৫৩.৬৫ একর ও রোপিত চা আবাদির পরিমাণ ছিল ১১৩৮.৪৮ একর।
পঞ্চগড় এ চা চাষের যে বিপ্লব ঘটেছে তা মূলত বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এ নিয়োজিত বিজ্ঞানীদের নিরলশ কর্ম প্রচেষ্টায়। যার ফলে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের এই অবহেলিত অঞ্চল মঙ্গা নামক অভিশাপ্ত শব্দটিকে জয় করতে পেরেছে। এতে করে এই উত্তরের জনপদটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে তেমনি এই অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবে অন্যতম চালিকা শক্তিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। পঞ্চগড়ের এই ক্ষুদ্র পর্যায়ের চা চাষকে আরও বিকাশিত ও ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) সাম্প্রতি পঞ্চগড়ের চা চাষিদের মাঝে বিনামূল্যে সিএফসি প্রকল্পের মাধ্যমে চার লক্ষ চা চারা বিতরণ করেছে। যা নিঃসন্দেহে অত্যান্ত প্রশংসনীয়। তাছাড়াও প্রতি বছরই বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা পঞ্চগড়ের চা চাষিদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক পন্থায় চা চাষের কলাকৌশল হাতে কলমে শেখানোর জন্য বিভিন্ন প্রকারের প্রশিক্ষনের আয়োজন করে থাকেন । এতে করে চা চাষিরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন তেমনি পঞ্চগড়ের চা চাষ আরও বেগমান হচ্ছে। ফলে এর উপকারিতা পঞ্চগড়ে চা চাষে জড়িত প্রত্যাক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ১২,০০০ লোক সহ হত দরিদ্র প্রায় ২,০০০ নারী ও পুরুষ সকলেই পাচ্ছে । সে কারনে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এর এই উপকেন্দ্রটি পঞ্চগড়ের লোকজনদের নিকট চায়ের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ।
তখনও পঞ্চগড়ের চা চাষিরা তাঁদের চয়নকৃত সবুজ চা পাতা বট লিফ চা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা না থাকার দরুন বিক্রয় করতে পারত না। সে সময়ে পঞ্চগড়ে চায়ের উৎপাদনের ব্যাপকতা দেখে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এর আর্থিক সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড এর কারিগরি সহযোগিতায় তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি (টিটিসিএল) নামক বট লিফ চা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা ২০০৪ ইং সালে তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত হয় । এতে করে পঞ্চগড়ের চা চাষে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় । এরপর হতে চা চাষিরা তাঁদের চয়নকৃত সবুজ চা পাতা ২০০৫ ইং সাল হতে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি(টিটিসিএল) এর নিকট বিক্রয় করতে শুরু করে । ২০০৮ ইং সালে পঞ্চগড়ে চা চাষে ব্যাপক সারা পরে, যার ফলে এই বৎসরে আরও চা চাষি তথা চা আবাদি বৃদ্ধি পায় । স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় চা চাষিদের পক্ষ থেকে পঞ্চগড়ে আরও একটি বট লিফ চা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা স্থাপনের দাবি এসেছিল । যার প্রেক্ষিতে উক্ত চা বছরে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড়ে করতোয়া বট লিফ চা কারখানা স্থাপিত হয়। এর ফলে পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হয় । ২০১১ ইং সালে এ বৎসরে পঞ্চগড়ের চায়ের উৎপাদনের উপর লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড়ে আরও দুটি বট লিফ চা কারখানা গ্রীন কেয়ার এগ্রো লিমিঃ ও গ্রীন এনার্জি টি ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় । ২০১৩ ইং সালে পঞ্চগড়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শক্রমে নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ফ্যাক্টরি নামক আরও একটি বট লিফ চা কারখানা স্থাপিত হয় । ২০১৬ সালে ৯টি চা বাগানের ৭৯৮.৪৩ হেক্টর জমিতে ৫০,১৬,৩৫২ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়াও পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র টি এস্টেট, ক্ষুদ্রায়তন চা চাষি ও ক্ষুদ্র চা চাষিদের মোট ১০৪৬.৮৪ হেক্টর জমিতে ৯৫,৫৬,৫৮৫ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। পঞ্চগড়ে সর্বমোট ১৮৪৫.২৭ হেক্টর জমিতে ১,৪৫,৭২,৯৩৭ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৭টি ফ্যাক্টরীতে মোট ৩২,০৬,০৪৬ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে।
দিনাজপুরে চায়ের চাষ
ধানের জেলা দিনাজপুরে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে চা। চা চাষের এই সাফল্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ইউপির ঝলঝলি গ্রামের নজরুল ইসলাম তার এক একর জমিতে চা চাষ শুরু করেন। সফলতাও পেয়েছেন আশাতীত। জমি প্রস্তুত করে চারা রোপণে তার খরচ করেছে ৬০ হাজার টাকা। আর গত বছরের আগস্টে চারা রোপণ করে এরই মধ্যে ৪ বার চা পাতা তুলেছেন। ২৫-২৬ টাকা কেজি দরে প্রায় ২৪ হাজার টাকার চা পাতাও বিক্রি করেছেন তিনি। গাছের বয়স ২ বছর হওয়ার পর প্রতি মাসে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকার চা পাতা বিক্রি করা যাবে বলে তিনি জানান। নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, চা গাছের গোড়ায় পানি না জমে সেজন্য জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোদে ছায়া দিতে চা গাছের মাঝে মাঝে নিমগাছ লাগিয়েছি। খরার সময় পাইপের সাহায্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হয় গাছে। বছরে ২ বার সার ব্যবহার করলেই চলে। আমি জৈব সার বেশি ব্যবহার করি। পলাশবাড়ী ঝলঝলি বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, পঞ্চগড়ের সাকোয়ার চা চারা বিক্রিকারী নার্সারির শরীফের পরামর্শে এবং চা বাগান করার নিজ আগ্রহে এ চা চাষ শুরু করি। পলাশবাড়ী ঝলঝলি বহুমুখী সমবায় সমিতির সহযোগিতায় গত বছরের আগস্টে চা চারা রোপণ করি। এরই মধ্যে চারবার চা পাতা সংগ্রহ করে পঞ্চগড় নর্থ বেঙ্গল চা কারখানায় বিক্রি করেছি। গাছের বয়স বাড়বে সঙ্গে চা পাতা সংগ্রহের পরিমাণও বাড়বে। হিমালয়ের পাদদেশে দিনাজপুরের অবস্থান হওয়ায় এ এলাকার চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া উপযুক্ত থাকায় এ উপজেলায় চা ভাল উৎপাদন হওয়া সম্ভব। চা গাছে নিবিড় পরিচর্যা, পরিমিত পানি সেচ, যত্নবান হতে হবে।
ঠাকুরগাঁও এ চায়ের চাষঃ
ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রথম চা চাষ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় কানিজ ফাতেমা ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নিটোলডোবা গ্রামে নাগর নদীর তীরে ২৫ একর জমির উপর একটি চা বাগান গড়ে তোলেন। পরে এই বাগানটি তিনি বিক্রি করে দেন গ্রীণফিল্ড টি এস্টেট কোম্পানির কাছে। গ্রীণফিল্ড টি এস্টেট বাগানটি সম্প্রসারিত করে মোট ৪৫ একর জমির উপর চা বাগান গড়ে তোলে। ঐ এলাকার ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা আরও ৪০ একর জমিতে ক্ষুদ্র পরিসরে চা বাগান গড়ে তুলেছেন। এর পর বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর এলাকার এমপি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আলহাজ্জ দবিরুল ইসলাম রনবাগ টি এস্টেট লিঃ নামে ২ বছর আগে দুটি চা বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এই প্রতিনিধি সম্প্রতি আলহাজ্জ দবিরুল ইসলামের চা বাগান পরিদর্শনে গেলে তিনি জানান, বাগান দুটি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিমি দূরে নদী নাগরের তীরে পাড়িয়া এলাকার রনবাগ এবং লাহিড়ী এলাকার পঞ্চুরহাট গ্রামে । রনবাগ গ্রামে জমির পরিমাণ ২৭০ বিঘা আর পঞ্চুরহাট গ্রামে জমির পরিমাণ ৪৫০ বিঘা । দবিরুল ইসলাম আরও জানান, চা চারা লাগানোর এক বছর পরই তিনি গত বছর ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে ৪ লক্ষ টাকার চা পাতা পঞ্চগড়ের করোতোয়া টি ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করেন। এবার তিনি দুটি বাগান থেকে ২০ লক্ষ টাকার চা পাতা বিক্রি করার আশা করেন। পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকায় বড় বড় চা বাগান গড়ে ওঠার পাশাপাশি প্রান্তিক চাষিরাও চা চাষ শুরু করেছেন। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নিটোলডোবা গ্রামের ৩৩ জন প্রান্তিক চাষি ৪০ একর জমিতে ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষ শুরু করেছেন। বর্তমানে ক্ষুদ্র চা চাষি রয়েছে ১২০ জন। তাদের সম্মিলিত জমির পরিমান পার্য ২০০ একর। বছরে প্রায় ৩ লাখ কেজি চা ক্ষুদ্র চা চাষিদের বাগান থেকে আহরিত হচ্ছে। ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় এলাকায় বড় পরিসরে এবং বিশেষ করে ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষের প্রচুর সম্ভাবনা বিরাজ করছে । চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে একদিকে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে অন্যদিকে উদ্বৃত্ত চা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
রংপুরে চায়ের চাষ
ঢাকা-রংপুরের মহাসড়ক ধরে উত্তরের সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার সময় পথের দু’ধারে দেখা মিলবে সারি সারি চা বাগান। চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজের সমারোহ এ বাগানগুলো দেখে। মনে হবে যেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং কিংবা শিলিগুড়ির পথে চলছি। সমতল জমিতে সারি সারি বাগানে চা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রমিকরা। মঙ্গা অঞ্চল নামে পরিচিত রংপুরে এখন উজ্জ্বল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে চা চাষ। এ অঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন প্রচুর চা চাষাবাদ হচ্ছে। অর্থকরী এ ফসল উৎপাদনে কৃষক পরিবারগুলোর মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। চা চাষের এ দৃশ্য এখন রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় চোখে পড়ে। প্রায় এক দশক আগে ব্যাপকহারে সীমান্তবর্তী পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় চা চাষ শুরু হয়। এখন তা সম্প্রসারিত হচ্ছে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। তাই এ অঞ্চলে চা চাষে সরকারি উদ্যোগ ও নজরদারী রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা নামের কলঙ্কমোচনে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা রাখছে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা চত্বর থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে রংপুর-দিনাজপুর হাইওয়ের সঙ্গে তারাগঞ্জ হাট। তার কিছু দূরে বাহাগিলী নামের একটি গ্রামের। বছর দুয়েক আগেও এ গ্রামের মাঠে শোভা পেত আলু আর তামাকের গাছ। এ বছর আলু আর তামাকের জায়গা দখল করে নিয়েছে চা বাগান। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ ও জলঢাকা এবং রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী তিনটি গ্রামের ৩০ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। সিনহা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এসব চা বাগানের মালিক। প্রতিষ্ঠানটির ইনচার্জ নওফেল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ১১ একর জমিতে চা বাগান করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ বাহাগিলিতে ৭ একর, দক্ষিণ দুরাকুটি গ্রামে ২ একর ও ইকরচালী ইউনিয়নের বরাতিতে ২ একর। ২০১৫ সালের ২ জুন এখানে চারা লাগানো হয়। চলতি বছরের জুলাই থেকে পাতা তোলা শুরু হয়েছে। এখন তা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে প্রায় ৩০ একরে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখানকার জমি উর্বর। চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আবহাওয়াও অনুকূল। সাধারণত চারা লাগানোর পর ৩-৪ বছর লাগে প্রোডাকশনে যেতে। অথচ এখানে আমরা এক বছরের মাথায় প্রোডাকশন শুরু করেছি, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, প্রতি ২০ দিন পর পর পাতা তুলে পঞ্চগড়ে বিক্রি করা হয়। ১১ একরের এ বাগান থেকে প্রতি চালানে ২৫ হাজার কেজি পাতা তোলা হচ্ছে। প্রতি কেজি পাতা ২৩ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে যতই দিন যাচ্ছে উৎপাদন ততই বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি চালানে উৎপাদন খরচ মিটিয়ে ১২-১৫ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। গাছের বয়স ২-৩ বছর হলে উৎপাদন অনেক বাড়বে কিন্তু উৎপাদন খরচ অনেক কমবে। তখন অনেক বেশি লাভ হবে। তিনি জানান, আগামী দু’এক বছরের মধ্যে ১০০ একর জমিতে চা বাগান করা এবং চা তৈরির কারখানা স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং এ এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যাবে।এ বাগানের ম্যানেজার রিফাত আনোয়ার বলেন, বর্তমানে বাগানে প্রতিদিন ২৫-৩০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তবে পাতা তোলার দিন ৪০-৫০ জন কর্মী লাগে। এ শ্রমিকদের অধিকাংশ স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা ও অসহায় নারী। তিনি জানান, এখানে টিভি-২৫-২৬, বিটি-২ এবং টিভি-২৩ জাতের চা লাগানো হয়েছে। এখানকার চায়ে ফাইবার কম, গ্রিন লিফ বেশি।
লালমনিরহাটে চা চাষ
সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের চাষ হয় হাতীবান্ধা উপজেলার পূর্ব বিছনদই এলাকায়। ওই গ্রামের ফেরদৌসের স্ত্রী শাহানারা বেগম সোমা জীবিকার সন্ধানে একটি এনজিও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন চায়ের এলাকা পঞ্চগড় জেলায়। সেখানকার চা বাগান মালিকদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখে নিজেও শখ করে চা গাছের চারা নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় রোপন করেন সোমা। সেই চায়ের গাছটি দিনে দিনে বড় হলে সোমার চা শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্নটাও বড় হতে থাকে। আস্তে আস্তে তিনি নিজ বাড়ির উঠানে গড়ে তোলেন চায়ের বাগান। এনজিওর চাকরি ছেড়ে দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে নিজের চা বাগানের পরিচর্যায় মনোযোগ দেন সোমা ও তার স্বামী ফেরদৌস আলম। এভাবেই শুরু। তারপরের ঘটনা এলাকার প্রায় সবারই জানা। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্থানীয় চা বাগান মালিক সেই সোমার সাথে যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠে সোমা এন্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের চা বাগানের স্বপ্নদ্রষ্টা শাহানা বেগম সোমা জানান, প্রথম দিকে অনেকটা শখ করেই চা বাগান শুরু করেন। সেই শখই একদিন চা শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্নকে লালন করেই সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি। চা শিল্প পুরোপুরি বিকাশ ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে লালমনিরহাটের চা। একইসঙ্গে জেলাবাসীর আর্থসামাজিক অবস্থারও ইতবাচক পরিবর্তন ঘটবে বলেও আশা করেন তিনি। সোমা দম্পতির একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা চা বাগান দেখে এ অঞ্চলের অনেকেই চা বাগান করায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এসব আগ্রহী চাষিদের সুবিধার জন্য এ দম্পতি পরবর্তীতে গড়ে তোলেন দু’টি চা গাছের নার্সারি। সেখান থেকে সুলভ মূল্যে চারা সংগ্রহ করে এখন অনেক কৃষকই গড়ে তুলেছেন চা বাগান। নতুন আরও অনেকেই এগিয়ে আসছেন চা বাগান করার পরিকল্পনা নিয়ে। হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়ার চা বাগান মালিক বদিউজ্জামান ভেলু বলেন, চা বাগানে একবার চারা রোপন করে পরিচর্যা করলেই কম খরচে অনেক মুনাফা পাওয়া যায়। তাই তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ২ একর জমিতে চা বাগান করেছি। পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা জমগ্রামের চাষী তাজুল ইসলাম ও দহগ্রামের চাষী বেলাল হোসেন বলেন, স্বল্প পরিশ্রমে ও কম খরচে অধিক মুনাফা পেতে চা চাষের বিকল্প নেই। বর্তমানে নিজ জেলায় টি প্রসেসিং কোম্পানি হওয়ায় বিক্রি করতেও ঝামেলা নেই। তাই দিন দিন এ জেলায় চা চাষীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও মনে করেন তারা। চা শিল্পের প্রসারে লালমনিরহাটে একটি চা বোর্ড গঠনের দাবি জানান এ দুই চা চাষী। বর্তমানে সীমান্তবর্তী এ জেলার ৫টি উপজেলায় দুইশ একর জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগান। নতুন করে ৫শ একর জমিতে চা বাগান করার প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানান সোমা টি প্রসেসিং লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস আলম। তিনি বলেন, এসব বাগানের পাতা সংগ্রহ ও পরিচর্যা করে গ্রামীণ অনেক নারী পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীণ বেকার জনগোষ্ঠীর কাজের সুযোগ তৈরী হওয়ায় নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন ব্যাপক অবদান। ফেরদৌস আলম জানান, এ অঞ্চলে প্রতি একর জমিতে চা উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭ মেট্রিক টন। সে অনুযায়ী বর্তমানে ২শত একর জমিতে মোট এক হাজার চার শত মেট্রিক টন চা উৎপান হচ্ছে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায়। ২শ একর জমির চা চাষী ৭৫জন। সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস আলম আরও জানান, প্রথম দিকে এ অঞ্চলের চাষীদের উৎপাদিত চা পাতা বিক্রি হত পঞ্চগড় জেলায়। দূরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে চার্ষীদের পরিবহন খরচ মেটানোর পর তেমন একটা মুনাফা হত না। তাই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চুক্তি করে যৌথ উদ্যোগে নিজ গ্রামে গড়ে তুলেন সোমা এন্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে চা পাতা সোধনাগার। যার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের নভেম্বরে। বর্তমানে এ অঞ্চলের চাষীরা প্রতি কেজি ১৮টাকা দরে সোমা টি প্রসেসিং এ কাঁচা চা পাতা সরবরাহ করছেন। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের জটিলতার কারণে সংযোগ না পাওয়ায় জেনারেটর দিয়েই চালু করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, দেশে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রাধিকার প্রকল্প সোমা এন্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড। যা বিদ্যুতের অভাবে অধিক ব্যয়ে জেনারেটর দিয়ে চালু করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার কারণে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। চা শিল্পের জন্য যথেষ্ট উপযোগী দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তি জেলা লালমনিরহাট। আর এ জেলার চা শিল্পের প্রসার ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন এ শিল্পের সাথে জড়িতরা।
নীলফামারীতে চায়ের চাষ
কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বর প্রায় ২২ একর জমি নিয়ে অবস্থিত। পতিত জমিগুলো ব্যবহারের লক্ষ্যে পঞ্চগড়ে চা বোর্ডের কর্মরত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে প্রথমে মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায় এ এলাকার মাটি চা চাষের উপযোগি। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান সৃস্টি ও উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে ১ বিঘা জমিতে প্রায় ২ হাজার চা চারা রোপন করে চা চাষ করে আশাতিত ফল পায়। চা চারা রোপনের অল্প দিনে চা গাছ গজাতে শুরু করে। পরবর্তীতে আরো চারা এনে উপজেলা পরিষদের পতিত প্রায় সাড়ে ৪ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। চা চাষ বৃদ্ধির লক্ষে সিনহা কোম্পানীর পতিত জমিতে চা চাষের জন্য উদ্বুদ্ধকরণের ফলে তারাও তাদের পতিত প্রায় ৯ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। উপজেলার কেশবা গুচ্ছগ্রাম সংলগ্ন পতিত প্রায় ৩ একর জমিতে করা হয়েছে চা চাষ। এছাড়া চাষ করা হয়েছে মাগুড়া ইউনিয়নে তহশিল অফিসের ১ বিঘা ও উপজেলা ভূমি অফিসের ১৫ শতাংশ পতিত জমিতে। চা চাষের সাফল্য দেখে এ এলাকার কৃষকদের বিষবৃক্ষ তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শুরু যেভাবেঃ নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ না থাকায় উপজেলার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকটসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে কি করে খাবে এ কথা ব্যক্ত করতেন। এসব ব্যক্তির কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তে ও জেলা প্রশাসনের পরামর্শে পরিষদের পতিত জমিতে চা চাষ শুরু করে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিঃ চা বাগান গুলো পুনর্বাসিত -দরিদ্রদের কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ এসে যদি বলতো কি করে খাবো তাকে ঘন্টা প্রতি ২০ টাকা করে শ্রমের মূল্য দিয়ে বাগানে কাজ করানো জন্য লাগানো হয়। দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করে ১৬০ টাকা করে পারিশ্রমিক পায়। চা বাগানের ফলে অলস হাত গুলো কর্মের হাতে পরিণত হয়েছে। ফলে ওই পরিবারগুলোতে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সৃজিত বাগানগুলোতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ জনের কর্মসংস্থান সৃস্টি হয়েছে।
উন্নয়নের প্রতীকি ফসলঃ চা একটি অভিজাত ও দীর্ঘজীবি ফসল। চা চারা একবার রোপন করলে আনুমানিক ৭০ বছর কমপক্ষে ৫০ বছর উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। বানিজ্যিকভাবে ৫০ বছর পাতা উত্তোলন করা যায়। চা চারা রোপনের ৩ বছর পর থেকে প্রতি বছরে একরে আনুমানিক ২ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকার পাতা উত্তোলন হয়। খরচ যেয়ে বছর ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা লাভ হয়। যা অন্যান্য ফসল থেকে আসে না। এছাড়া অন্যান্য ফসলে কোন বছরে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পারে আবার কোন বছর লোকসান হয়। সেখানে চা চাষ প্রতি বছর একরে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা লাভ দেয়। অন্যদিকে যে জমিতে কোন ফসল হয় না অথবা দিনের পর দিন পরে থাকতো এরকম পতিত জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে চা গাছ। লোকসান বিহীন ফসলের চাষ, পতিত জমিগুলো ব্যবহার আর কর্মসংস্থান সৃস্টি হওয়ায় চা চাষ উন্নয়নের প্রতীকি ফসলের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তামাকের পরিবর্তে চা চাষঃ বিষবৃক্ষ তামাক চাষ খ্যাত এলাকা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলা। তামাক চাষের ফলে এলাকার ধানসহ বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চলে যাচ্ছে তামাক চাষের কবলে। এতে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। তামাক চাষের ফলে তামাক চাষী, পরিবারের সদস্য ও পার্শ্ববর্তী লোকজনের স্বাস্থ্যহানিসহ নানা রকম রোগে ভুগতে থাকে। তামাক চাষ ক্ষতিকারক বুঝতে পেরে কৃষকরা তামাক চাষের পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব চা চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। এ ফসল এ এলাকার জন্য তামাকের বিকল্প ফসলে রুপান্তর হবে এমটাই ভাবছে অনেকে।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণঃ চা চারা রোপনের ১ বছর ৬ মাস থেকে চা পাতা উত্তোলন যোগ্য হওয়ায় তা তুলে সনাতন পদ্ধতিতে চা তৈরি করা শুরু হয়েছে। কাচাঁ পাতা উত্তোলন করে প্রথমে বাছাই করা হয়। এর কাঁচা পাতা ঢেঁকি দিয়ে পিসিয়ে তা ভাজা হয়। ভাজা চা পাতার গুরাগুলো পরিস্কার করে চা তৈরি করা হয়। তাজা পাতা তাজা খ্রান সমৃদ্ধ চা প্যাকেটজাত করে স্থানীয় বাজারে কেজি প্রতি ৩ শত টাকা বিক্রি শুরু হয়েছে।
কাইজেন টিঃ স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত চায়ের নাম দেয়া হয়েছে কাইজেন টি। কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন অফিসসহ বাজারের দোকানগুলোতে কাইজেন টি বাজারজাত শুরু হওয়ায় এলাকার মানুষজন তা কিনে খাচ্ছে। এর কদরও দিন দিন বাড়ছে। তাজা পাতার তাজা চায়ের স্বাদে এলাকার মানুষ এ চা দিব্বি কিনছে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে চলতি বছরে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ১ লক্ষ্য চা চারা রোপনের জন্য বিতরণ করার টার্গেট নেয়া হয়েছে। উপজেলা পরিষদে সরকারীভাবে চা নার্সারী তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। এছাড়া আগামী ২০২০ সালের মধ্যে নীলফামারী জেলায় ২৫ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ডের। তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে চা চাষে বাংলাদেশ চা বোর্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৬ জন তামাক চাষী চা চাষের জন্য নিবন্ধন করেছে বলেও চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে তথ্য অনুসারে জানা গেছে যে, চা চাষের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আনুমানিক ৫০ জন পুনর্বাসিত ভিক্ষুকের কর্মসংস্থান সৃস্টি হয়েছে। তাছাড়া তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে চা চাষে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন তামাক চাষী চা চাষের অভিমত ব্যক্ত করেছে ও নিবন্ধনও করেছেন। পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান, কিশোরগঞ্জ উপজেলার আর্থিক উন্নয়ন ও উপজেলা পরিষদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে চা চাষ শুরু করা হয়েছে। চা বাগানের নাম কাইজেন টি গার্ডেন রাখার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তিনি জানান- কাইজেন জাপানী শব্দ। কাই শব্দের অর্থ- ছোট আকারে পরিবর্তন আর জেন শব্দের অর্থ- ভালো। এককথায় কাইজেন শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে ভালোর জন্য পরিবর্তন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জানান- চা চাষ একদিকে যেমন উপজেলা পরিষদের রাজস্ব বৃদ্ধি করবে অন্যদিকে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃস্টি হবে। আমাদের চা চাষে সাফল্য দেখে অনেক কৃষক তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এছাড়া চা চাষে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। চা চাষের ফলে এ উপজেলার আমুল উন্নতি হবে।
বান্দরবানে চা চাষ
চা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে। পার্বত্য জেলাগুলোতে ক্ষুদ্রাতায়নে চা চাষ করা হলে এখানকার দারিদ্র বিমোচন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসায়িক যোগাযোগসহ দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির পাহাড়ী এলাকা চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ২০০৩ সালে তিন পার্বত্য জেলায় প্রথম পর্যায়ে ৩০০ হেক্টর জমিতে চা চাষের পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্পের আওতায় বান্দরবানে ২০০৫ সাল থেকে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ প্রকল্পের আওতায় ৩৩০ জন ক্ষুদ্রায়তন চা চাষির ৫১৬ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা ও বান্দরবান সদর উপজেলায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ক্ষুদ্র চাষিরা চা চাষ করেছেন। তবে প্রকল্পের আওতায় রুমা উপজেলায় ৯৬ পরিবারে, বান্দরবান সদর উপজেলায় ৬০ পরিবারে এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৩৯ পরিবারে অর্থাৎ মোট ১৯৫ পরিবারে ৬ লাখ ৭ হাজার ৪ দশত চা চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। পাহাড়ে কৃষকেরা ধীরে ধীরে চা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে নতুন চা কারখানা স্থাপিত হওয়ায় বান্দরবানের নতুন চায়ের ব্র্যান্ড বাজারে আসবে। এই চা হবে গুণে ও মানে উৎকৃষ্ট। এছাড়াও কক্সবাজার জেলায় ২ হাজার ২৮০ হেক্টর জমি রয়েছে। তবে অজ্ঞাত কারণে কক্সবাজারে এখনও চা উৎপাদর শুরু হয়নি। হয়ত অচিরেই এ জেলায়ও শুরু হবে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ। চা চাষের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব।
বৃহদায়তন চা বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সৃজনের মাধ্যমে দেশের চা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি জেলায় ৫০ হেক্টর, খাগড়াছড়ি জেলায় ২৫ হেক্টর এবং বান্দরবান জেলায় ২২৫ হেক্টরসহ তিন পাবর্ত্য জেলায় ৩০০ হেক্টর এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১০২৯.৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে আগস্ট ২০০৩ হতে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য ‘স্মল হোল্ডিং টি কালটিভেশন ইন চিটাগাং হিল ট্রাক্টস’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেয়া হয়। উক্ত প্রকল্পের আওতায় ৫২ জন স্মল গ্রোয়ার্স/হোল্ডার এ পর্যন্ত বান্দরবানে ১১০ হেক্টর, মানিকছড়িতে ৩.২০ হেক্টর এবং রাঙ্গামাটিতে ১.৮২ হেক্টর অর্থাৎ মোট ১১৫.০২ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনয়ন করেছে। বান্দরবান জেলার স্মল গ্রোয়ার্সদের সংঘটিত করার জন্য ইতোমধ্যে একটি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। উক্ত এলাকায় ২০১০ সালে চা পাতা চয়ন শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে ৩১,০০০ কেজি সবুজ চা পাতা চয়ন করা হয়েছে, তা থেকে ৫,৭৮৫ কেজি মেইড টি তৈরী হয়েছে। বান্দরবানে উৎপাদিত ক্লোন চা এখন চট্টগ্রাম নিলামে উচ্চমূল্যে বিক্রয় হচ্ছে যা ক্রেতা জনসাধারণের নিকট সমাদৃত হয়েছে।
দেশের পঞ্চগড় ও পার্বত্য বান্দরবান জেলায় খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর সিএফসি অর্থায়নে ১টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষীদের চা চাষে প্রশিক্ষণ প্রদান, ১০.০০ লক্ষ চা চারা উত্তোলন পূর্বক ক্ষুদ্র চাষীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ এবং ১০টি সবুজ চা পাতা সংগ্রহ কেন্দ্র ও ১০টি সমবায় কেন্দ্র স্থাপন, ২টি পিকআপ, ৩টি লাইট ট্রাক, ৩টি মোটর সাইকেল ক্রয়, প্রভৃতি কাজ অন্তর্ভুক্ত করে সিএফসি অর্থায়নে একটি প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড।
ময়মনসিংহে চায়ের চাষ
সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ের পরে এবার গারো পাহাড়ের পাদদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল জেলায় চায়ের আবাদ শুরু হচ্ছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড গারো পাহাড়ের পাদদেশে অনুর্বর টিলায় চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করে এ অঞ্চলে চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে। তবে উদ্যোক্তা, জমি এবং অর্থায়নের অভাবে তখন সেখানে আর চা চাষ হয়নি। গারো হিলস টি কোম্পানি নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীতে গারো ও হাজং জাতিসত্তা অধ্যুষিত এলাকায় এ চাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। ২০১৭ সালে ১৩ জন স্থানীয় কৃষককে তিনি পঞ্চগড়ে চা চাষ দেখতে পাঠান। এরপর গত বছরের এপ্রিল মাসে তিন উপজেলার ২৬ জন কৃষক এ চাষ শুরু করেন। চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে এখন শতাধিক কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানান কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা জনাব আমজাদ হোসেন। তিনি দুই লাখ চারা দিয়ে একটি নার্সারি তৈরি করেছেন। এখন শেরপুরের তিন উপজেলায় ক্ষুদ্র চা চাষি উন্নয়ন কমিটি তৈরি করা হয়েছে। ২৬ জন্য সদস্য আছেন কমিটিতে। আরও ৯৮ জন নতুন সদস্য প্রক্রিয়াধীন। বর্তমানে ২৪ জন ক্ষুদ্র চা চাষি ৫.৩১ একর জমিতে চা চাষ করছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক বৃহত্তর ময়মনসিংহে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প গ্রহণের নিমিত্তে পুনরায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। উক্ত যাচাই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহে জেলাসমূহে মোট ১৩,৬৪৫ একর জমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ সম্ভব। ক্ষুদ্র আকারে চা চাষ জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ এখান থেকে দ্রুত এবং স্থায়ী আয় হয়। এখন দেশের ভবিষ্যৎ এই সীমিত আকারের চায়ের চাষে। কারণ, যে হারে চায়ের চাহিদা বাড়ছে তাতে এই ধারার চায়ের আবাদের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ চা বোর্ডের লক্ষ্য ২০২০ সালে ১ কোটি কেজি চা ক্ষুদ্র খাত থেকে উৎপাদন করা। আর ২০৩০ সালে তা হবে ৩ কোটি কেজি চা। ওই সময় দেশের মোট চা উৎপাদন হবে ১৪ কোটি কেজি এবং চাহিদা থাকবে ১৩ কোটি কেজি। এর মধ্যে ৩ কোটি কেজি আসবে ক্ষুদ্র পরিসর থেকে। কেবল ১০ জেলায় নয়, দেশের ২৫ জেলায় ক্ষুদ্র আকারে চায়ের আবাদ সম্ভব।