চায়ের ক্ষতিকারক রোগবালাই ও এদের প্রতিকার ব্যবস্থা
রোগবালাই পরিচিতিঃ
সমস্ত গাছ পালা রোগ বালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা চারা অবস্থায়ও চা গাছ বিভিন্ন রোগ বালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত: ছত্রাক ও শৈবাল জাতীয় জীবাণু দ্বারা চা গাছের রোগসমূহ সংঘঠিত হয়ে থাকে। রোগসমূহ কিছু সময় স্বল্প পরিসরে আবার অনেক সময় ব্যাপক আকার ধারণ করে চায়ের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে থাকে। পোকা-মাকড়ের মত রোগের জীবাণুসমূহ খালী চোখে দেখা যায় না বিধায় সাধারণত এদের গুরুত্ব কম দেয়া হয় এবং অনেক সময় এদের ক্ষতিকর অবস্থাও নিরুপন করা হয় না। তবে সঠিক জ্ঞান থাকলে প্রতিটি রোগের আলামত (Symptom) দেখে এদের চিহ্নিত করা যায়। সঠিকভাবে আক্রান্ত রোগটি চিহ্নিত করতে পারলে তা দমন করা সহজ হয় এবং এদের ক্ষতি থেকে গাছকে বাঁচানো যায় তথা ফসলহানী থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রোগ বালাই এর পাশাপাশি আগাছাও চা বাগানসমূহে ফসলহানী বা উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। রোগ বালাই ও আগাছা চা গাছের বড় শত্রু। আমাদের দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় কেবলমাত্র রোগের কারণে প্রায় ১০-১৫% এবং আগাছার কারণে প্রায় ১০-১২% চায়ের ফলন কমে যায়। যথাসময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিকারের অভাবে সম্পূর্ণ ফলনও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ চা’য়ে ২০ টি জীবাণুঘটিত রোগ ও ৪০ প্রকার আগাছা সনাক্ত এবং লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বছরে এক এক সময়ে এক এক রোগ-বালাই ও আগাছার প্রাদূর্ভাব পরিলক্ষিত হতে পারে। এদের প্রাদূর্ভাব বাগান হতে বাগানে, সেকশন হতে সেকশনে ভিন্নতর হতে পারে। এমনকি একই গাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাই দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে।
(ক) চা গাছের প্রধান প্রধান রোগ-বালাইসমূহ:
সাধারণত বিভিন্ন রোগজীবাণু গাছের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রমণ করে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় যে সমস্ত রোগজীবাণু চা গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্গ আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করে থাকে, তাদেরকে গাছের অবস্থান ভেদে তিনভাগে ভাগ করে বিভিন্ন অংশের প্রধান প্রধান রোগ-বালাইসমূহ নিম্নে প্রদান করা হল:
পাতায় এবং গাছের অগ্রভাগের রোগ-বালাই সমূহঃ (১) গল ডিজিস বা গুটি রোগ, (২) ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগ, (৩) পাতা পঁচা রোগ, (৪) ব্রাউন ও গ্রে ব্লাইট এবং (৫) ফোঁসকা রোগ ইত্যাদি।
ডাল পালা এবং গাছের মধ্যভাগের রোগ-বালাই সমূহঃ (১) রেড রাষ্ট বা লাল মরিচা রোগ, (২) ব্রাঞ্চ ক্যান্কার বা ডালপালার ঘা রোগ, (৩) হর্স হেয়ার ব্লাইট এবং (৪) থ্রেড ব্লাইট রোগ ইত্যাদি
গোড়ায় এবং গাছের নিম্নভাগের রোগ-বালাই সমূহঃ (১) চারকোল ষ্টাম্প রট, (২) কলার রট, (৩) ভায়োলেট রুট রট, (৪) পারপল রুট রট ইত্যাদি
১) পাতা পচা বা ব্ল্যাক রট
লক্ষণঃ এ রোগ চা আবাদী এলাকায় পাতা চয়নতলের নিচের পরিনত পাতাসমূহে আক্রমণ করে। Corticium invisum এবং C. theae নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ সংঘঠিত হয়। মে, জুন, জুলাই মাসে মাঠে এ রোগ বেশী দেখা যায়। প্রবল বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টিপাত ও পাতা চয়নকারীদের ব্যবহৃত কাপড় এবং ঝুড়ীর মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার লাভ করে। অত্যাধিক ছায়া, আর্দ্র ও স্যাঁতস্যতে আবহাওয়া এবং পুনিংত্তোর গাছের উপর রেখে যাওয়া পুনিং লিটার ইত্যাদি এ রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য সাহায়ককারী উপাদান। এ রোগের কারনে পাতাগুলো প্রথমে হালকা বাদামী রং ধারণ করে ও ক্রমশ রং পরিবর্তিত হয়ে কাল হতে থাকে। পাতার মাঝের অংশ ও কিনারা ধুসর বাদামীতে পরিণত হয়। ভেজা অবস্থায় কাল দেখা যায়। কোন কোন সময় মরা পাতা ছত্রাকের সাহায্যে ডালের সঙ্গে ঝুলে থাকে বা পাতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
প্রতিকারঃ রোগের জীবাণু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না হলে প্রত্যেক বৎসরেই এ রোগ দেখা দিতে পারে। এরূপ অবস্থায় গাছ দুর্বল হয় এবং পাতা দেয়ার ক্ষমতা রহিত হয়। প্রতিকার হিসাবে প্রথমে রোগাক্রান্ত গাছগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যতটুকু সম্ভব আক্রান্ত পাতাগুলো হাত দিয়ে পরিষ্কার করে হেক্টর প্রতি ৭৫০ গ্রাম নোইন ৫০ ডব্লিউ পি (কার্বেন্ডাজিম জাতীয়) অথবা ২.৮ কেজি কুপ্রাভিট ৫০ ডব্লিউ পি (কপার জাতীয়) ছত্রাক নাশক ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পুরোগাছে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। পুরোপুরিভাবে এ রোগের প্রতিকারকল্পে ১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার উক্ত ওষুধ ভালভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আক্রান্ত পাতাগুলো পুড়িয়ে বা গর্তে পুতে ফেলা বাঞ্চনীয়। প্রুনিং এর সময় প্রুনিং লিটারগুলোও সতর্কতার সহিত সরিয়ে অন্যত্র পুড়িয়ে বা গর্তে পুতে ফেলা উচিত। এ রোগাক্রান্ত এলাকায় প্রয়োজনাতিরিক্ত ছায়া গাছ পাতলা করা উচিত এবং নালা ব্যবস্থাও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পরবর্তী ২/৩ বছর এভাবে ব্যবস্থা নিলে এ রোগ সমূলে বিনাশ সাধন করা যায়।
২) ফোস্কা রোগ বা ব্লিস্টার ব্লাইট
রোগের লক্ষণঃ ছোট ছোট হালকা দাগ পরিলক্ষিত হয়। নরম ডগা ও কচি পাতায় আক্রান্ত অংশ ফুলে গিয়ে ফোঁস্কার আকার ধারণ করে। ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে ফোস্কাগুলো বাদামী এবং পরে কালো হয়ে শুকিয়ে যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে কপার হাইড্রক্সাইড যেমন- চ্যাম্পিয়ন ৭৭ ডব্লিউ পি ২.২৪ কেজি হারে অথবা ট্রাইডিমর্ফ যেমন- ক্যালিক্সিন ৮০ ইসি ১.১২ লিটার হারে হেক্টর প্রতি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
৩) ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগ
রোগের লক্ষণঃ অরিণত গাছের গোড়ায় এ রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। আক্রমণে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, সত্বর পাতাগুলো বাদামী রং ধারণ করে এবং মাটির সমান্তরালে ১-২ সেমি উপরে বাকল ফেটে রিং আকারে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে গাছের গোড়া পেন্সিলের মতো সরু ও চিকণ হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে হেক্টর প্রতি ২ লিটার হারে ফরমালডিহাইড যেমন- ফরমালিন (৪০%) অথবা ২.৮ কেজি হারে কপার অক্সিক্লোরাইড যেমন- এমিভিট ৫০ ডব্লিউপি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
৪) হর্স হেয়ার ব্লাইট
রোগের লক্ষণঃ চা গাছের মধ্য ক্যানোপি রোগ সমূহের মধ্যে হর্স হেয়ার ব্লাইট একটি মারাত্বক রোগ। মেরাসমিয়াস ইকুইক্রিনাস (মোল) নামক ছত্রাকের আক্রমনে এই রোগ সংঘঠিত হয়। পূর্ণবর্ধিত ও বয়স্ক চা গাছের ইহা একটি সাধারণ রোগ। এই রোগ বর্ষজীবী প্রকৃতির। যদি সঠিক ভাবে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে একই সেকশনে অথবা একই গাছে ইহা বছরের পর বছর সতেজ থাকে এবং স্থায়ীত্ব লাভ করে। রোগের তীব্রতার তারতম্যের কারণে ফসলহানির পরিমান ভিন্ন হয়। সাধারণত এই রোগের কারণে ফসল হানির পরিমান শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ, কিন্তু রোগ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ থাকলে এই ক্ষতির পরিমান শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশী হয়। রোগ বিস্তারের অনুকূল নিয়ামকসমূহ বিরাজমান থাকলে ব্যাপক শস্যহানি হতে পারে। সাধারনত: রোগ বিস্তারের অনুকূল নিয়ামকসমূহ হল, অত্যাধিক ছায়া, স্যাঁতস্যাতে অবস্থা, কুঞ্চি এরিয়া, অতি নিকটে বাঁশ ঝাড়ের অবস্থান, প্রুণিং এর সময় আবর্জনাসমূহ চা গাছের উপর পতিত হওযা, নিম্ন মানের নিষ্কাশন ব্যবস্থা। সাধারণতঃ জুন মাস থেকে আগস্ট মাসে যখন উষ্ণ, আর্দ্র ও স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া বিরাজ করে তখন এই রোগের জীবানু সক্রিয় হয়ে উঠে। এই রোগের জীবানুর বিশেষত্ব হচ্ছে যে, ইহা কোন স্পোর উৎপন্ন করে না। প্রবল বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টির ফোটা, বাতাস বাহিত বৃষ্টির পানি, প্রুণিং লিটার, কৃষি যন্ত্রপাতি, চা পাতা চয়নকারীর ব্যবহৃত ঝুড়ি এবং কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। হর্স হেয়ার ব্লাইট রোগ দ্বারা সৃষ্ট রোগের লক্ষণ সমূহ সনাক্ত করা কঠিন, তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আক্রান্ত চা গাছ গুলো খুব দুর্বল এবং অসতেজ মনে হয়। খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে, আক্রান্ত চা গাছের উপর আক্রমনকারী ছত্রাকের উজ্জ্বল কালো বর্ণের সূত্রক বা কর্ড দেখা যায়। যেহেতু ছত্রাকগুলোকে একত্রে হর্স হেয়ারের মত মনে হয় সে কারণে এই জীবানু দ্বারা সৃষ্ট রোগকে হর্স হেয়ার ব্লাইট রোগ বলা হয়। ছত্রাকের এই সূত্রক বা কর্ড গুলো আক্রান্ত চা গাছের কাঠামোতে ছড়ায়ে পড়ে এবং বিজড়িত করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে, আক্রান্ত গাছের সক্রিয় সালোকসংশ্লেষণ এরিয়া হ্রাস পায়। গাছের কার্যক্ষম গভীরতা পর্যন্ত সূর্যালোক প্রবেশ করতে না পারায় সালোকসংশ্লেষণের পরিমানও কম হয়।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত সেকশনের আশেপাশে জঙ্গল থাকলে তা পরিস্কার করা উচিত। যে সব সেকশনের অত্যাধিক ছায়া তরু অপসারণ করা সম্ভব নয়, সেগুলোর শাখা- প্রশাখা বর্ষার প্রারম্ভেই ছাঁটাই করে পাতলা করে দেয়া যেতে পারে। প্রুণিং এর পর প্রুণিং লিটার কখনই চা গাছের উপর ছড়াইয়া ছিটাইয়া রাখা উচিত নয়। আক্রান্ত সেকশনে চা গাছের উপর পতিত ছায়া তরুর পাতা, আবর্জনা, প্রুণিং এর পর আবর্জনাসহ ভিতর থেকে ফাঙ্গাল সূত্রক বা কর্ড সমূহকে অপসারণ করলে এই রোগের আক্রমনের তীব্রতা অনেকাংশে কমে যায়। যে সব সেকশনের নিষ্কাশন অবস্থা ভালো নয়, সে সব সেকশনে এই রোগের অক্রমন বেশী হয়। তাই সেকশনের ভূমির বন্ধুরতা অনুযায়ী নালা প্রতিষ্ঠা করে এবং নালার রক্ষণাক্ষেণ করে নিষ্কাশন অবস্থা উন্নত করা উচিত। হেক্টর প্রতি ১০০০ লিটার পানিতে ৭৫০ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম (এমকোজিম ৫০ ডব্লিউপি) মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রেয় করলে সুফল পাওয়া যায়।
৫) রেড রাস্ট বা লাল মরিচা রোগ
রোগের লক্ষণঃ অপ্রাপ্ত অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক সব বয়সের চা গাছ এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। Cephaleorus parasiticus নামক শৈবাল দ্বারা এই রোগ সংঘঠিত হয়। বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিলে এ রোগ দেখা যায়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ রোগের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। বৃষ্টিপাত, শিশির, ঝড়োবাতাস, পাতা নড়াচড়া এবং বৃষ্টির পানি ইত্যাদির মাধ্যমে একস্থান হতে অন্যস্থানে, একগাছ হতে অন্য গাছে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমান সারের অভাব, জলাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত নালা ব্যবস্থা, অত্যাধিক আগাছা, খরা ও অপর্যাপ্ত ছায়া ব্যবস্থা এ রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য সহকারী। বগামেডুলা নামক অস্থায়ী ছায়া গাছও এই রোগে আক্রান্ত হয় বিধায় অন্যতম পোষক হিসাবে কাজ করে । সাধারনত: এক বছরের অধিক বয়ষ্ক ডালে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। রোগাক্রান্ত ডাল বা কান্ডের উপর লাল / কমলা রংয়ের চুলের মত অঙ্গানু সৃস্টি হয় তখন ইহার আক্রান্ত এলাকাগুলো মরিচার মত দেখায় বিধায় এ'কে লাল মরিচা বা রেড রাস্ট বলা হয়। আক্রান্তকান্ডের পাতা গুলো হলুদ হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ বগামেডুলা নামক অস্থায়ী ছায়া গাছ এই রোগের অন্যতম পোষক বিধায় দু’ বছর বয়সের পুর্বেই বগামেডুলা চা আবাদীতে হতে কেটে সরিয়ে ফেলা উচিত। কেননা এখান থেকে চা তে রোগটি বিস্তার লাভ করতে পারে। এ রোগ গাছকে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে বিধায় পর পর কয়েক বছর কোন এলাকায় এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হলে পরবর্তী বছর সে এলাকায় রোগ সংঘঠিত হওয়ার পূর্বে অনুকূল নিয়ামকসমূহের (ফ্যাক্টরগুলো) জরুরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। উক্ত এলাকায় অনুমোদিত মাত্রায় সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। ছায়া গাছবিহীন স্থানে প্রয়োজনীয় পরিমান ছায়া গাছ রোপন করা উচিত এবং নালা ব্যবস্থা উন্নত ও পরিস্কার করে জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে। রোগ আক্রান্ত এলাকায় হেক্টর প্রতি ২.৮ কেজি কুপ্রাভিট ৫০ ডব্লিউ পি অথবা যে কোন ৫০% কপার জাতীয় ছত্রাক নাশক ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের আগা হতে গোড়া পর্যন্ত সমস্ত ডালপালা গুলোতে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। সফলভাবে এ রোগ দমনার্থে ১৫ দিন অন্তর আরও ২/৩ বার উক্ত ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
৬) স্ফীতি বা গল রোগ
লক্ষণঃ এক ধরনের ছত্রাকজনিত রোগের কারণের এ রোগ দেখা দেয়। এ রোগের আক্রমণে চা গাছের পাতার বোটা ও ডালে টিউমারের মত কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে, ফলে নতুন কান্ড সৃষ্টি ব্যহত হয়। চায়ের ফলন কমে যায়। সাধারণত বিটি১ ক্লোনের গাছে গল রোগ দেখা যায়।
প্রতিকারঃ আক্রমণ বেশি হলে আক্রান্ত সেকশন এলপি অথবা ডিএসকে করতে হবে। সেকশন থেকে প্রুনিং লিটারগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কান্ডে টিউমারটি বড় হলে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে কাটা স্থানে কপারের পেস্ট লাগাতে হবে। আক্রান্ত সেকশনে হেক্টর ৭৫০ গ্রাম হারে কার্বেন্ডাজিম (নোয়িন ৫০ ডব্লিউপি) অথবা ২.২৪ কেজি হারে কপার হাইড্রক্সিক্লোরাইড (চ্যাম্পিয়ন ৭৭ ডব্লিউপি) ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। ১৪ দিন পর ২য় রাউন্ড স্প্রে করতে হবে।
৭) ব্রাঞ্চ ক্যাংকার বা ক্ষত রোগ
রোগের লক্ষণঃ চা গাছের শাখা প্রশাখা বা মূল কান্ডে এ রোগের আক্রমণ বেশী পরিলক্ষিত হয়। আক্রান্ত অংশে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে ক্ষতটি বড় হতে থাকে। সব বয়সের গাছেই কমবেশী এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে পুরানো প্রায় সকল গাছের শাখা প্রশাখা, কান্ড ও গোড়া এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। জীবানুটি একটি উন্ড প্যারাসাইট প্রকৃতির ছত্রাক। যে কোন ক্ষতের মাধ্যমে গাছকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত অংশে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে ক্ষতটি বড় হতে থাকে। বাকলের নিচে শক্ত কাঠ আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে যায়। গাছের গোড়ায় এ রোগের আক্রমণ তীব্র হলে শীঘ্রই গাছ মারা যায়। তীব্র খরা, ছায়াবিহীন অবস্থা, শিলা বৃষ্টি, প্রুণিং এর সময় ক্ষত সৃষ্টি হওয়া, আগাছা দমনের সময় দা-কোদাল প্রভৃতির দ্বারা গাছের গোড়া বা কান্ডে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি এ রোগ সংক্রমনের জন্য সহায়ক। বৃষ্টির পানি, পিপড়া, উঁইপোকা এবং প্রুণিং দা ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগের জীবাণু বিস্তার লাভ করে থাকে। এ রোগ আক্রমনের ফলে কান্ড বা গোড়ার আক্রান্ত স্থানে এক বিশেষ ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষতস্থানটি গোলাকার ক্যালাস বেষ্টিত থাকে। আক্রান্ত স্থানের বাকল শুকিয়ে ঈষৎ কাল রং ধারণ করে। কিনারায় হতে ক্যালাস সৃষ্টি হয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হতে থাকে। অনেক সময় ক্ষতের উপর ক্যালাস বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হয়ে অল্প সময়ে আক্রান্ত অংশকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে কিন্তু রোগটি ভিতরে থেকে যায় ও ক্রমান্নয়ে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত ডালপালাসমূহ দূর্বল হয়ে পড়ে এবং গাছটি মারা যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে ম্যাকুপ্রক্স ১৬ ডব্লিউ ২.২৪ কেজি হারে হেক্টর প্রতি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত কান্ডে বা শাখা প্রশাখায় স্প্রে করতে হবে। রোগ সংঘঠিত হওয়ার পূর্বে রোগ অনুকূল নিয়ামকসমূহের (ফ্যাক্টরগুলো) জরুরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। শিলায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় এবং প্রুণিত্তোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনুমোদিত যে কোন একটা ছত্রাক নাশক ছিটাতে হবে। আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করলে আক্রান্ত স্থানের ৫ সেমি নিচে কিয়দাংশ অপসারণ পূর্বক কাটা স্থানে ছত্রাক নাশক এর পেষ্ট তৈরী করে ব্রাশ দ্বারা প্রলেপ দিতে হবে।
৮) কলার রট বা গোড়াপচা রোগ
রোগের লক্ষণঃ অরিণত গাছের গোড়ায় এ রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। আক্রমণে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, সত্বর পাতাগুলো বাদামী রং ধারণ করে এবং মাটির সমান্তরালে ১-২ সেমি উপরে বাকল ফেটে রিং আকারে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে গাছের গোড়া পেন্সিলের মতো সরু ও চিকণ হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে হেক্টর প্রতি ২ লিটার হারে ফরমালডিহাইড যেমন- ফরমালিন (৪০%) অথবা ২.৮ কেজি হারে কপার অক্সিক্লোরাইড যেমন- এমিভিট ৫০ ডব্লিউপি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
৯) চারকোল ষ্টাম্প রট বা অংগার রোগ
রোগের লক্ষণঃ বাংলাদেশ চায়ে গাছের গোড়া ও শিকড় রোগের মধ্যে চারকোল ষ্টাম্প রট রোগটিই প্রধান। গাছের গোড়া ও শিকড়ের মধ্যে Ustulina deusta নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। যে কোন বয়সের বা জাতের চা গাছ এবং ছায়া গাছকে এ জীবাণু আক্রমণ করতে পারে। গাছের গোড়া ও শিকড়ে এ রোগ আক্রামণ করে থাকে বিধায় রোগাক্রান্ত গাছ বাঁচানো খুবই কষ্টসাধ্য। সঠিক সময়ে দমনের ব্যবস্থা না নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ মারা যায়। এ রোগ মাটি বাহিত বিধায় খুব দ্রুত আশে-পাশের গাছগুলোও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমনকি সমস্ত সেকশানটিই এর আক্রমণের কবলে পড়তে পারে। অত্যাধিক স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া, ছায়া ও অত্যধিক আর্দ্রতাযুক্ত পরিবেশ রোগের আক্রমনের প্রধান উৎস বলে বিবেচিত। বর্ষা মৌসুমের সময় বা পরে রোগের আক্রমন বেশী দেখা যায়। বালি মাটিতে এ রোগের তীব্রতা বেশী পরিলক্ষিত হয়। সাধারণতঃ এপ্রিল-মে মাস থেকে যখন আর্দ্র ও স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া বিরাজ করে তখন এই রোগের জীবানু সক্রিয় হয়ে উঠে। রোগাক্রান্ত গাছ এককভাবে অথবা বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি গাছ একই জায়গায় হঠাৎ করে মারা যায়। পাতা ঝলসে যায় এবং আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। বাদামী-লাল রং এর ঝলসানো পাতাগুলো কিছুদিন ডালে লেগে থাকে এবং ডাল নাড়া দিলেও পাতাগুলো গাছ হতে ঝরে পড়ে না। আক্রান্ত গাছের গোড়ায় ও শিকড়ের উপর অসংখ্য ছোট ছোট কয়লার মত দানাদার গুটি দেখা যায়। ছত্রাকের ফ্রুকটিফিকেশন এবং আবরণ কয়লার ন্যায় দেখা যায় বিধায় এ রোগের নামকরণ চারকোল ষ্টাম্প রট করা হয়েছে। অনেক সময় শিকড়ের উপর ছত্রাকের বীজকণা পরিলক্ষিত হবার পূর্বেই গাছ মরে যেতে থাকে। আক্রমণ তীব্র হলে বাকলের নিচে ছত্রাকের মাইসেলিয়াম পরিদৃষ্ট হয়।
প্রতিকারঃ সঠিক সময়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে না পারলে গাছ মারা যায় বিধায় আক্রমণের লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই প্রতিকার ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে চার পার্শ্বের এক সারি সুস্থগাছসহ আক্রান্ত এলাকার চতুর্দিকে ৩০ সেমি বা ১ ফুট চওড়া এবং ৩০ সেমি বা ৩ ফুট গভীর বিশিষ্ট গর্ত করে গাছকেগুলোকে পৃথকীকরণ করে পরবর্তীতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। সরাসরি ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করেও এ রোগ দমন করা যায়। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ ও তার চার পাশে অন্তত: দুই সারি সুস্থগাছে ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করতে হবে। এর জন্য প্রথমে কাঁটা কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ফরমালিন মিশ্রিত করে ঝাঁঝরির সাহায্যে আস্তে আস্তে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই যেন ফরমালিন মিশ্রিত পানি গাছের পাতায় না পড়ে। ফরমালিন প্রয়োগের পর গাছের গোড়া মালচিং করে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি মালচিং এর উপরও প্রয়োগ করা ভাল। সম্পূর্ণ মরাগাছ শিকড়সহ তুলে ফেলে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে এবং পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ৭ দিন পর পলিথিন সারিয়ে মাটিগুলো ঝুরঝুরে করে আরও ২ দিন অপেক্ষা করে (ফরমালিনের গ্যাস বিতাড়িত করার জন্য) নুতন চারা লাগানো যাবে।
১০) ভায়োলেট রুট রট রোগ
লক্ষণঃ জলাবদ্ধতার কারণে চা গাছের গোড়ায় এ রোগ দেখা দেয়। আক্রান্ত গাছের পাতাগুলো ধীরে ধীরে হলুদ হতে থাকে এবং নেতিয়ে পড়ে। অঙ্গার রোগের সাথে মূল পার্থক্য হচ্ছে পাতাগুলো হালকা নাড়ায় ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ সঠিক সময়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে না পারলে গাছ মারা যায় বিধায় আক্রমণের লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই প্রতিকার ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে চার পার্শ্বের এক সারি সুস্থগাছসহ আক্রান্ত এলাকার চতুর্দিকে ৩০ সেমি বা ১ ফুট চওড়া এবং ৩০ সেমি বা ৩ ফুট গভীর বিশিষ্ট গর্ত করে গাছকেগুলোকে পৃথকীকরণ করে পরবর্তীতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। সরাসরি ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করেও এ রোগ দমন করা যায়। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ ও তার চার পাশে অন্তত: দুই সারি সুস্থগাছে ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করতে হবে। এর জন্য প্রথমে কাঁটা কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ফরমালিন মিশ্রিত করে ঝাঁঝরির সাহায্যে আস্তে আস্তে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই যেন ফরমালিন মিশ্রিত পানি গাছের পাতায় না পড়ে। ফরমালিন প্রয়োগের পর গাছের গোড়া মালচিং করে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি মালচিং এর উপরও প্রয়োগ করা ভাল। সম্পূর্ণ মরাগাছ শিকড়সহ তুলে ফেলে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে এবং পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ৭ দিন পর পলিথিন সারিয়ে মাটিগুলো ঝুরঝুরে করে আরও ২ দিন অপেক্ষা করে (ফরমালিনের গ্যাস বিতাড়িত করার জন্য) নুতন চারা লাগানো যাবে।
চায়ের আগাছা দমন
চা আবাদীতে চা গাছ ও ছায়াতরু ব্যতীত অনাবশ্যক যে কোন গাছপালাকে আগাছা বলা যেতে পারে। গাছের সঠিক পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য আগাছা দমন অপরিহার্য। কেননা আগাছা পানি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের জন্য চা গাছের সঙ্গে প্রতিযোগীতা করে এবং প্রয়োজনীয় আলো বাতাসও ব্যাহত করে। তাছাড়া পোকামাকড় ও রোগবালাই বিস্তারে সহায়তা করে। সাধারণত নিড়ানী, কোদাল ও কাস্তের সাহায্যে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ পদ্ধতি ব্যয় বহুল, শ্রমনির্ভর ও কষ্টসাধ্য হলেও পরিবেশ বান্ধব। ভরামৌসুমে চায়ের বৃদ্ধি যখন ভাল হয়, পাশাপাশি চা আবাদীতে আগাছার আধিক্যও বৃদ্ধি পায়। তখন শ্রমিক স্বল্পতাহেতু নির্ধারিত মাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগের মাধ্যমে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ এবং এটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় দ্রুত আগাছা দমন করা সম্ভব। তবে উঁচু টিলার উপরে বা খাড়া টিলার ঢালে কোন অবস্থাতেই আগাছানাশক প্রয়োগ করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে চা আবাদীতে যে সকল আগাছাসমূহ জন্মে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ এর সুবিধার্থে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায়। নরম ও অকাষ্ঠলগুলোকে এক-বীজপত্রী এবং শক্ত ও কাষ্ঠলগুলোকে দ্বি-বীজপত্রী আগাছা হিসাবে ভাগ করা হয়ে থাকে। চা আবাদীতে কোন কোন সেকশনে এক-বীজপত্রী এবং কোন কোন সেকশনে দ্বি-বীজপত্রী আগাছা জন্মিয়ে থাকে। আবার কোন কোন সেকশনে এক-বীজপত্রী ও দ্বি-বীজপত্রী উভয় প্রকার আগাছা জন্মিয়ে থাকে। কিছু আগাছা নাশক আছে শুধুমাত্র এক-বীজপত্রী জাতীয় আগাছাকে দমন করে কিন্তু দ্বি-বীজপত্রী আগাছার উপর কাজ করে না। অন্যদিকে কিছু আগাছা নাশক আছে শুধুমাত্র দ্বি-বীজপত্রী জাতীয় আগাছাকে দমন করে কিন্তু এক-বীজপত্রী আগাছার উপর কাজ করে না। আবার কিছু আগাছা নাশক আছে এক-বীজপত্রী ও দ্বি-বীজপত্রী উভয় জাতীয় আগাছাকে দমন করে থাকে। সব আগাছা নাশক সব আগাছা উপর কাজ করে না বিধায় আগাছা নাশক দ্বারা আগাছা দমন করতে গেলে সেকশনের আগাছার ধরণ তথা কোন্ জাতীয় আগাছা বিদ্যমান তা দেখে আগাছা নাশক ব্যবহার করা উচিত।
অন্যদিকে নার্সারীতে আগাছাসমূহ দমন কল্পে দু’ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। (১) স্ট্যান্ডিং নার্সারীতে হাত বাছাই করে এবং (২) নার্সারীর বেডে (চারা লাগানোর পূর্বে) প্রি-ইমার্জেন্ট জাতীয় আগাছা নাশক প্রয়োগ করে।
এক-বীজপত্রী আগাছাসমূহ: দুর্বা ঘাস, ছন ঘাস, মুথা ঘাস, আঙ্গুলী ঘাস ইত্যাদি।
দ্বি-বীজপত্রী আগাছাসমূহ: বাগরাকোট, মিকানিয়ালতা, নিশি, লজ্জাবতী, ঘেটু, কুকর শুঙ্গা, ছোট দুধীয়া, বড় দুধীয়া, কলকা সন্ধা, বিষকাটালী, বন পটল, তেলা কুচি, শ্বেতদ্রোন, থানকুনী ইত্যাদি।
আগাছার দমনকৌশলঃ আগাছানাশক ও এদের হেক্টর প্রতি মাত্রা নিম্নে দেয়া হলোঃ
একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী উভয় প্রকার আগাছা বিদ্যমান থাকলে গ্লাইফোসেট জাতীয় যেমন- রাউন্ডআপ, এমকোরাউন্ড, সানআপ, রিড উইড, বাই মাস্টার @ হেক্টর প্রতি ৩.৫ লি./ ৭৫০ লিটার পানি অথবা প্যারাকোয়াট জাতীয় যেমন- গ্রামোক্সোন, পিলারক্সন, প্যারাক্সোন @ হেক্টর প্রতি ২.৮ লি./ ৭৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
কেবলমাত্র এক-বীজপত্রী আগাছা বিদ্যমান থাকলে ডালাপন @ হেক্টর প্রতি ৬.৭২ কেজি./৭৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
কেবলমাত্র দ্বি-বীজপত্রী আগাছা বিদ্যমান থাকলে ২,৪-ডি জাতীয় যেমন- ২,৪-ডি, কেম এমাইন @ হেক্টর প্রতি ২.৮ কেজি./৭৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
রোগবালাই পরিচিতিঃ
সমস্ত গাছ পালা রোগ বালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা চারা অবস্থায়ও চা গাছ বিভিন্ন রোগ বালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত: ছত্রাক ও শৈবাল জাতীয় জীবাণু দ্বারা চা গাছের রোগসমূহ সংঘঠিত হয়ে থাকে। রোগসমূহ কিছু সময় স্বল্প পরিসরে আবার অনেক সময় ব্যাপক আকার ধারণ করে চায়ের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে থাকে। পোকা-মাকড়ের মত রোগের জীবাণুসমূহ খালী চোখে দেখা যায় না বিধায় সাধারণত এদের গুরুত্ব কম দেয়া হয় এবং অনেক সময় এদের ক্ষতিকর অবস্থাও নিরুপন করা হয় না। তবে সঠিক জ্ঞান থাকলে প্রতিটি রোগের আলামত (Symptom) দেখে এদের চিহ্নিত করা যায়। সঠিকভাবে আক্রান্ত রোগটি চিহ্নিত করতে পারলে তা দমন করা সহজ হয় এবং এদের ক্ষতি থেকে গাছকে বাঁচানো যায় তথা ফসলহানী থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রোগ বালাই এর পাশাপাশি আগাছাও চা বাগানসমূহে ফসলহানী বা উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। রোগ বালাই ও আগাছা চা গাছের বড় শত্রু। আমাদের দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় কেবলমাত্র রোগের কারণে প্রায় ১০-১৫% এবং আগাছার কারণে প্রায় ১০-১২% চায়ের ফলন কমে যায়। যথাসময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিকারের অভাবে সম্পূর্ণ ফলনও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ চা’য়ে ২০ টি জীবাণুঘটিত রোগ ও ৪০ প্রকার আগাছা সনাক্ত এবং লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বছরে এক এক সময়ে এক এক রোগ-বালাই ও আগাছার প্রাদূর্ভাব পরিলক্ষিত হতে পারে। এদের প্রাদূর্ভাব বাগান হতে বাগানে, সেকশন হতে সেকশনে ভিন্নতর হতে পারে। এমনকি একই গাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাই দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে।
(ক) চা গাছের প্রধান প্রধান রোগ-বালাইসমূহ:
সাধারণত বিভিন্ন রোগজীবাণু গাছের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রমণ করে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় যে সমস্ত রোগজীবাণু চা গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্গ আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করে থাকে, তাদেরকে গাছের অবস্থান ভেদে তিনভাগে ভাগ করে বিভিন্ন অংশের প্রধান প্রধান রোগ-বালাইসমূহ নিম্নে প্রদান করা হল:
পাতায় এবং গাছের অগ্রভাগের রোগ-বালাই সমূহঃ (১) গল ডিজিস বা গুটি রোগ, (২) ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগ, (৩) পাতা পঁচা রোগ, (৪) ব্রাউন ও গ্রে ব্লাইট এবং (৫) ফোঁসকা রোগ ইত্যাদি।
ডাল পালা এবং গাছের মধ্যভাগের রোগ-বালাই সমূহঃ (১) রেড রাষ্ট বা লাল মরিচা রোগ, (২) ব্রাঞ্চ ক্যান্কার বা ডালপালার ঘা রোগ, (৩) হর্স হেয়ার ব্লাইট এবং (৪) থ্রেড ব্লাইট রোগ ইত্যাদি
গোড়ায় এবং গাছের নিম্নভাগের রোগ-বালাই সমূহঃ (১) চারকোল ষ্টাম্প রট, (২) কলার রট, (৩) ভায়োলেট রুট রট, (৪) পারপল রুট রট ইত্যাদি
১) পাতা পচা বা ব্ল্যাক রট
লক্ষণঃ এ রোগ চা আবাদী এলাকায় পাতা চয়নতলের নিচের পরিনত পাতাসমূহে আক্রমণ করে। Corticium invisum এবং C. theae নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ সংঘঠিত হয়। মে, জুন, জুলাই মাসে মাঠে এ রোগ বেশী দেখা যায়। প্রবল বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টিপাত ও পাতা চয়নকারীদের ব্যবহৃত কাপড় এবং ঝুড়ীর মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার লাভ করে। অত্যাধিক ছায়া, আর্দ্র ও স্যাঁতস্যতে আবহাওয়া এবং পুনিংত্তোর গাছের উপর রেখে যাওয়া পুনিং লিটার ইত্যাদি এ রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য সাহায়ককারী উপাদান। এ রোগের কারনে পাতাগুলো প্রথমে হালকা বাদামী রং ধারণ করে ও ক্রমশ রং পরিবর্তিত হয়ে কাল হতে থাকে। পাতার মাঝের অংশ ও কিনারা ধুসর বাদামীতে পরিণত হয়। ভেজা অবস্থায় কাল দেখা যায়। কোন কোন সময় মরা পাতা ছত্রাকের সাহায্যে ডালের সঙ্গে ঝুলে থাকে বা পাতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
প্রতিকারঃ রোগের জীবাণু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না হলে প্রত্যেক বৎসরেই এ রোগ দেখা দিতে পারে। এরূপ অবস্থায় গাছ দুর্বল হয় এবং পাতা দেয়ার ক্ষমতা রহিত হয়। প্রতিকার হিসাবে প্রথমে রোগাক্রান্ত গাছগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যতটুকু সম্ভব আক্রান্ত পাতাগুলো হাত দিয়ে পরিষ্কার করে হেক্টর প্রতি ৭৫০ গ্রাম নোইন ৫০ ডব্লিউ পি (কার্বেন্ডাজিম জাতীয়) অথবা ২.৮ কেজি কুপ্রাভিট ৫০ ডব্লিউ পি (কপার জাতীয়) ছত্রাক নাশক ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পুরোগাছে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। পুরোপুরিভাবে এ রোগের প্রতিকারকল্পে ১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার উক্ত ওষুধ ভালভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আক্রান্ত পাতাগুলো পুড়িয়ে বা গর্তে পুতে ফেলা বাঞ্চনীয়। প্রুনিং এর সময় প্রুনিং লিটারগুলোও সতর্কতার সহিত সরিয়ে অন্যত্র পুড়িয়ে বা গর্তে পুতে ফেলা উচিত। এ রোগাক্রান্ত এলাকায় প্রয়োজনাতিরিক্ত ছায়া গাছ পাতলা করা উচিত এবং নালা ব্যবস্থাও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পরবর্তী ২/৩ বছর এভাবে ব্যবস্থা নিলে এ রোগ সমূলে বিনাশ সাধন করা যায়।
২) ফোস্কা রোগ বা ব্লিস্টার ব্লাইট
রোগের লক্ষণঃ ছোট ছোট হালকা দাগ পরিলক্ষিত হয়। নরম ডগা ও কচি পাতায় আক্রান্ত অংশ ফুলে গিয়ে ফোঁস্কার আকার ধারণ করে। ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে ফোস্কাগুলো বাদামী এবং পরে কালো হয়ে শুকিয়ে যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে কপার হাইড্রক্সাইড যেমন- চ্যাম্পিয়ন ৭৭ ডব্লিউ পি ২.২৪ কেজি হারে অথবা ট্রাইডিমর্ফ যেমন- ক্যালিক্সিন ৮০ ইসি ১.১২ লিটার হারে হেক্টর প্রতি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
৩) ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগ
রোগের লক্ষণঃ অরিণত গাছের গোড়ায় এ রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। আক্রমণে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, সত্বর পাতাগুলো বাদামী রং ধারণ করে এবং মাটির সমান্তরালে ১-২ সেমি উপরে বাকল ফেটে রিং আকারে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে গাছের গোড়া পেন্সিলের মতো সরু ও চিকণ হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে হেক্টর প্রতি ২ লিটার হারে ফরমালডিহাইড যেমন- ফরমালিন (৪০%) অথবা ২.৮ কেজি হারে কপার অক্সিক্লোরাইড যেমন- এমিভিট ৫০ ডব্লিউপি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
৪) হর্স হেয়ার ব্লাইট
রোগের লক্ষণঃ চা গাছের মধ্য ক্যানোপি রোগ সমূহের মধ্যে হর্স হেয়ার ব্লাইট একটি মারাত্বক রোগ। মেরাসমিয়াস ইকুইক্রিনাস (মোল) নামক ছত্রাকের আক্রমনে এই রোগ সংঘঠিত হয়। পূর্ণবর্ধিত ও বয়স্ক চা গাছের ইহা একটি সাধারণ রোগ। এই রোগ বর্ষজীবী প্রকৃতির। যদি সঠিক ভাবে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে একই সেকশনে অথবা একই গাছে ইহা বছরের পর বছর সতেজ থাকে এবং স্থায়ীত্ব লাভ করে। রোগের তীব্রতার তারতম্যের কারণে ফসলহানির পরিমান ভিন্ন হয়। সাধারণত এই রোগের কারণে ফসল হানির পরিমান শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ, কিন্তু রোগ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ থাকলে এই ক্ষতির পরিমান শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশী হয়। রোগ বিস্তারের অনুকূল নিয়ামকসমূহ বিরাজমান থাকলে ব্যাপক শস্যহানি হতে পারে। সাধারনত: রোগ বিস্তারের অনুকূল নিয়ামকসমূহ হল, অত্যাধিক ছায়া, স্যাঁতস্যাতে অবস্থা, কুঞ্চি এরিয়া, অতি নিকটে বাঁশ ঝাড়ের অবস্থান, প্রুণিং এর সময় আবর্জনাসমূহ চা গাছের উপর পতিত হওযা, নিম্ন মানের নিষ্কাশন ব্যবস্থা। সাধারণতঃ জুন মাস থেকে আগস্ট মাসে যখন উষ্ণ, আর্দ্র ও স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া বিরাজ করে তখন এই রোগের জীবানু সক্রিয় হয়ে উঠে। এই রোগের জীবানুর বিশেষত্ব হচ্ছে যে, ইহা কোন স্পোর উৎপন্ন করে না। প্রবল বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টির ফোটা, বাতাস বাহিত বৃষ্টির পানি, প্রুণিং লিটার, কৃষি যন্ত্রপাতি, চা পাতা চয়নকারীর ব্যবহৃত ঝুড়ি এবং কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। হর্স হেয়ার ব্লাইট রোগ দ্বারা সৃষ্ট রোগের লক্ষণ সমূহ সনাক্ত করা কঠিন, তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আক্রান্ত চা গাছ গুলো খুব দুর্বল এবং অসতেজ মনে হয়। খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে, আক্রান্ত চা গাছের উপর আক্রমনকারী ছত্রাকের উজ্জ্বল কালো বর্ণের সূত্রক বা কর্ড দেখা যায়। যেহেতু ছত্রাকগুলোকে একত্রে হর্স হেয়ারের মত মনে হয় সে কারণে এই জীবানু দ্বারা সৃষ্ট রোগকে হর্স হেয়ার ব্লাইট রোগ বলা হয়। ছত্রাকের এই সূত্রক বা কর্ড গুলো আক্রান্ত চা গাছের কাঠামোতে ছড়ায়ে পড়ে এবং বিজড়িত করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে, আক্রান্ত গাছের সক্রিয় সালোকসংশ্লেষণ এরিয়া হ্রাস পায়। গাছের কার্যক্ষম গভীরতা পর্যন্ত সূর্যালোক প্রবেশ করতে না পারায় সালোকসংশ্লেষণের পরিমানও কম হয়।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত সেকশনের আশেপাশে জঙ্গল থাকলে তা পরিস্কার করা উচিত। যে সব সেকশনের অত্যাধিক ছায়া তরু অপসারণ করা সম্ভব নয়, সেগুলোর শাখা- প্রশাখা বর্ষার প্রারম্ভেই ছাঁটাই করে পাতলা করে দেয়া যেতে পারে। প্রুণিং এর পর প্রুণিং লিটার কখনই চা গাছের উপর ছড়াইয়া ছিটাইয়া রাখা উচিত নয়। আক্রান্ত সেকশনে চা গাছের উপর পতিত ছায়া তরুর পাতা, আবর্জনা, প্রুণিং এর পর আবর্জনাসহ ভিতর থেকে ফাঙ্গাল সূত্রক বা কর্ড সমূহকে অপসারণ করলে এই রোগের আক্রমনের তীব্রতা অনেকাংশে কমে যায়। যে সব সেকশনের নিষ্কাশন অবস্থা ভালো নয়, সে সব সেকশনে এই রোগের অক্রমন বেশী হয়। তাই সেকশনের ভূমির বন্ধুরতা অনুযায়ী নালা প্রতিষ্ঠা করে এবং নালার রক্ষণাক্ষেণ করে নিষ্কাশন অবস্থা উন্নত করা উচিত। হেক্টর প্রতি ১০০০ লিটার পানিতে ৭৫০ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম (এমকোজিম ৫০ ডব্লিউপি) মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রেয় করলে সুফল পাওয়া যায়।
৫) রেড রাস্ট বা লাল মরিচা রোগ
রোগের লক্ষণঃ অপ্রাপ্ত অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক সব বয়সের চা গাছ এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। Cephaleorus parasiticus নামক শৈবাল দ্বারা এই রোগ সংঘঠিত হয়। বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিলে এ রোগ দেখা যায়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ রোগের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। বৃষ্টিপাত, শিশির, ঝড়োবাতাস, পাতা নড়াচড়া এবং বৃষ্টির পানি ইত্যাদির মাধ্যমে একস্থান হতে অন্যস্থানে, একগাছ হতে অন্য গাছে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমান সারের অভাব, জলাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত নালা ব্যবস্থা, অত্যাধিক আগাছা, খরা ও অপর্যাপ্ত ছায়া ব্যবস্থা এ রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য সহকারী। বগামেডুলা নামক অস্থায়ী ছায়া গাছও এই রোগে আক্রান্ত হয় বিধায় অন্যতম পোষক হিসাবে কাজ করে । সাধারনত: এক বছরের অধিক বয়ষ্ক ডালে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। রোগাক্রান্ত ডাল বা কান্ডের উপর লাল / কমলা রংয়ের চুলের মত অঙ্গানু সৃস্টি হয় তখন ইহার আক্রান্ত এলাকাগুলো মরিচার মত দেখায় বিধায় এ'কে লাল মরিচা বা রেড রাস্ট বলা হয়। আক্রান্তকান্ডের পাতা গুলো হলুদ হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ বগামেডুলা নামক অস্থায়ী ছায়া গাছ এই রোগের অন্যতম পোষক বিধায় দু’ বছর বয়সের পুর্বেই বগামেডুলা চা আবাদীতে হতে কেটে সরিয়ে ফেলা উচিত। কেননা এখান থেকে চা তে রোগটি বিস্তার লাভ করতে পারে। এ রোগ গাছকে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে বিধায় পর পর কয়েক বছর কোন এলাকায় এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হলে পরবর্তী বছর সে এলাকায় রোগ সংঘঠিত হওয়ার পূর্বে অনুকূল নিয়ামকসমূহের (ফ্যাক্টরগুলো) জরুরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। উক্ত এলাকায় অনুমোদিত মাত্রায় সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। ছায়া গাছবিহীন স্থানে প্রয়োজনীয় পরিমান ছায়া গাছ রোপন করা উচিত এবং নালা ব্যবস্থা উন্নত ও পরিস্কার করে জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে। রোগ আক্রান্ত এলাকায় হেক্টর প্রতি ২.৮ কেজি কুপ্রাভিট ৫০ ডব্লিউ পি অথবা যে কোন ৫০% কপার জাতীয় ছত্রাক নাশক ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের আগা হতে গোড়া পর্যন্ত সমস্ত ডালপালা গুলোতে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। সফলভাবে এ রোগ দমনার্থে ১৫ দিন অন্তর আরও ২/৩ বার উক্ত ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
৬) স্ফীতি বা গল রোগ
লক্ষণঃ এক ধরনের ছত্রাকজনিত রোগের কারণের এ রোগ দেখা দেয়। এ রোগের আক্রমণে চা গাছের পাতার বোটা ও ডালে টিউমারের মত কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে, ফলে নতুন কান্ড সৃষ্টি ব্যহত হয়। চায়ের ফলন কমে যায়। সাধারণত বিটি১ ক্লোনের গাছে গল রোগ দেখা যায়।
প্রতিকারঃ আক্রমণ বেশি হলে আক্রান্ত সেকশন এলপি অথবা ডিএসকে করতে হবে। সেকশন থেকে প্রুনিং লিটারগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কান্ডে টিউমারটি বড় হলে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে কাটা স্থানে কপারের পেস্ট লাগাতে হবে। আক্রান্ত সেকশনে হেক্টর ৭৫০ গ্রাম হারে কার্বেন্ডাজিম (নোয়িন ৫০ ডব্লিউপি) অথবা ২.২৪ কেজি হারে কপার হাইড্রক্সিক্লোরাইড (চ্যাম্পিয়ন ৭৭ ডব্লিউপি) ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। ১৪ দিন পর ২য় রাউন্ড স্প্রে করতে হবে।
৭) ব্রাঞ্চ ক্যাংকার বা ক্ষত রোগ
রোগের লক্ষণঃ চা গাছের শাখা প্রশাখা বা মূল কান্ডে এ রোগের আক্রমণ বেশী পরিলক্ষিত হয়। আক্রান্ত অংশে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে ক্ষতটি বড় হতে থাকে। সব বয়সের গাছেই কমবেশী এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে পুরানো প্রায় সকল গাছের শাখা প্রশাখা, কান্ড ও গোড়া এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। জীবানুটি একটি উন্ড প্যারাসাইট প্রকৃতির ছত্রাক। যে কোন ক্ষতের মাধ্যমে গাছকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত অংশে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে ক্ষতটি বড় হতে থাকে। বাকলের নিচে শক্ত কাঠ আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে যায়। গাছের গোড়ায় এ রোগের আক্রমণ তীব্র হলে শীঘ্রই গাছ মারা যায়। তীব্র খরা, ছায়াবিহীন অবস্থা, শিলা বৃষ্টি, প্রুণিং এর সময় ক্ষত সৃষ্টি হওয়া, আগাছা দমনের সময় দা-কোদাল প্রভৃতির দ্বারা গাছের গোড়া বা কান্ডে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি এ রোগ সংক্রমনের জন্য সহায়ক। বৃষ্টির পানি, পিপড়া, উঁইপোকা এবং প্রুণিং দা ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগের জীবাণু বিস্তার লাভ করে থাকে। এ রোগ আক্রমনের ফলে কান্ড বা গোড়ার আক্রান্ত স্থানে এক বিশেষ ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষতস্থানটি গোলাকার ক্যালাস বেষ্টিত থাকে। আক্রান্ত স্থানের বাকল শুকিয়ে ঈষৎ কাল রং ধারণ করে। কিনারায় হতে ক্যালাস সৃষ্টি হয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হতে থাকে। অনেক সময় ক্ষতের উপর ক্যালাস বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হয়ে অল্প সময়ে আক্রান্ত অংশকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে কিন্তু রোগটি ভিতরে থেকে যায় ও ক্রমান্নয়ে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত ডালপালাসমূহ দূর্বল হয়ে পড়ে এবং গাছটি মারা যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে ম্যাকুপ্রক্স ১৬ ডব্লিউ ২.২৪ কেজি হারে হেক্টর প্রতি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত কান্ডে বা শাখা প্রশাখায় স্প্রে করতে হবে। রোগ সংঘঠিত হওয়ার পূর্বে রোগ অনুকূল নিয়ামকসমূহের (ফ্যাক্টরগুলো) জরুরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। শিলায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় এবং প্রুণিত্তোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনুমোদিত যে কোন একটা ছত্রাক নাশক ছিটাতে হবে। আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করলে আক্রান্ত স্থানের ৫ সেমি নিচে কিয়দাংশ অপসারণ পূর্বক কাটা স্থানে ছত্রাক নাশক এর পেষ্ট তৈরী করে ব্রাশ দ্বারা প্রলেপ দিতে হবে।
৮) কলার রট বা গোড়াপচা রোগ
রোগের লক্ষণঃ অরিণত গাছের গোড়ায় এ রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। আক্রমণে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, সত্বর পাতাগুলো বাদামী রং ধারণ করে এবং মাটির সমান্তরালে ১-২ সেমি উপরে বাকল ফেটে রিং আকারে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে গাছের গোড়া পেন্সিলের মতো সরু ও চিকণ হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ এ রোগ দমনে হেক্টর প্রতি ২ লিটার হারে ফরমালডিহাইড যেমন- ফরমালিন (৪০%) অথবা ২.৮ কেজি হারে কপার অক্সিক্লোরাইড যেমন- এমিভিট ৫০ ডব্লিউপি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
৯) চারকোল ষ্টাম্প রট বা অংগার রোগ
রোগের লক্ষণঃ বাংলাদেশ চায়ে গাছের গোড়া ও শিকড় রোগের মধ্যে চারকোল ষ্টাম্প রট রোগটিই প্রধান। গাছের গোড়া ও শিকড়ের মধ্যে Ustulina deusta নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। যে কোন বয়সের বা জাতের চা গাছ এবং ছায়া গাছকে এ জীবাণু আক্রমণ করতে পারে। গাছের গোড়া ও শিকড়ে এ রোগ আক্রামণ করে থাকে বিধায় রোগাক্রান্ত গাছ বাঁচানো খুবই কষ্টসাধ্য। সঠিক সময়ে দমনের ব্যবস্থা না নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ মারা যায়। এ রোগ মাটি বাহিত বিধায় খুব দ্রুত আশে-পাশের গাছগুলোও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমনকি সমস্ত সেকশানটিই এর আক্রমণের কবলে পড়তে পারে। অত্যাধিক স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া, ছায়া ও অত্যধিক আর্দ্রতাযুক্ত পরিবেশ রোগের আক্রমনের প্রধান উৎস বলে বিবেচিত। বর্ষা মৌসুমের সময় বা পরে রোগের আক্রমন বেশী দেখা যায়। বালি মাটিতে এ রোগের তীব্রতা বেশী পরিলক্ষিত হয়। সাধারণতঃ এপ্রিল-মে মাস থেকে যখন আর্দ্র ও স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া বিরাজ করে তখন এই রোগের জীবানু সক্রিয় হয়ে উঠে। রোগাক্রান্ত গাছ এককভাবে অথবা বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি গাছ একই জায়গায় হঠাৎ করে মারা যায়। পাতা ঝলসে যায় এবং আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। বাদামী-লাল রং এর ঝলসানো পাতাগুলো কিছুদিন ডালে লেগে থাকে এবং ডাল নাড়া দিলেও পাতাগুলো গাছ হতে ঝরে পড়ে না। আক্রান্ত গাছের গোড়ায় ও শিকড়ের উপর অসংখ্য ছোট ছোট কয়লার মত দানাদার গুটি দেখা যায়। ছত্রাকের ফ্রুকটিফিকেশন এবং আবরণ কয়লার ন্যায় দেখা যায় বিধায় এ রোগের নামকরণ চারকোল ষ্টাম্প রট করা হয়েছে। অনেক সময় শিকড়ের উপর ছত্রাকের বীজকণা পরিলক্ষিত হবার পূর্বেই গাছ মরে যেতে থাকে। আক্রমণ তীব্র হলে বাকলের নিচে ছত্রাকের মাইসেলিয়াম পরিদৃষ্ট হয়।
প্রতিকারঃ সঠিক সময়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে না পারলে গাছ মারা যায় বিধায় আক্রমণের লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই প্রতিকার ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে চার পার্শ্বের এক সারি সুস্থগাছসহ আক্রান্ত এলাকার চতুর্দিকে ৩০ সেমি বা ১ ফুট চওড়া এবং ৩০ সেমি বা ৩ ফুট গভীর বিশিষ্ট গর্ত করে গাছকেগুলোকে পৃথকীকরণ করে পরবর্তীতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। সরাসরি ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করেও এ রোগ দমন করা যায়। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ ও তার চার পাশে অন্তত: দুই সারি সুস্থগাছে ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করতে হবে। এর জন্য প্রথমে কাঁটা কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ফরমালিন মিশ্রিত করে ঝাঁঝরির সাহায্যে আস্তে আস্তে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই যেন ফরমালিন মিশ্রিত পানি গাছের পাতায় না পড়ে। ফরমালিন প্রয়োগের পর গাছের গোড়া মালচিং করে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি মালচিং এর উপরও প্রয়োগ করা ভাল। সম্পূর্ণ মরাগাছ শিকড়সহ তুলে ফেলে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে এবং পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ৭ দিন পর পলিথিন সারিয়ে মাটিগুলো ঝুরঝুরে করে আরও ২ দিন অপেক্ষা করে (ফরমালিনের গ্যাস বিতাড়িত করার জন্য) নুতন চারা লাগানো যাবে।
১০) ভায়োলেট রুট রট রোগ
লক্ষণঃ জলাবদ্ধতার কারণে চা গাছের গোড়ায় এ রোগ দেখা দেয়। আক্রান্ত গাছের পাতাগুলো ধীরে ধীরে হলুদ হতে থাকে এবং নেতিয়ে পড়ে। অঙ্গার রোগের সাথে মূল পার্থক্য হচ্ছে পাতাগুলো হালকা নাড়ায় ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ সঠিক সময়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে না পারলে গাছ মারা যায় বিধায় আক্রমণের লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই প্রতিকার ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে চার পার্শ্বের এক সারি সুস্থগাছসহ আক্রান্ত এলাকার চতুর্দিকে ৩০ সেমি বা ১ ফুট চওড়া এবং ৩০ সেমি বা ৩ ফুট গভীর বিশিষ্ট গর্ত করে গাছকেগুলোকে পৃথকীকরণ করে পরবর্তীতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। সরাসরি ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করেও এ রোগ দমন করা যায়। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ ও তার চার পাশে অন্তত: দুই সারি সুস্থগাছে ৪০% ফরমালিন প্রয়োগ করতে হবে। এর জন্য প্রথমে কাঁটা কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ফরমালিন মিশ্রিত করে ঝাঁঝরির সাহায্যে আস্তে আস্তে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই যেন ফরমালিন মিশ্রিত পানি গাছের পাতায় না পড়ে। ফরমালিন প্রয়োগের পর গাছের গোড়া মালচিং করে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি মালচিং এর উপরও প্রয়োগ করা ভাল। সম্পূর্ণ মরাগাছ শিকড়সহ তুলে ফেলে দিতে হবে। ফরমালিন মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে এবং পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ৭ দিন পর পলিথিন সারিয়ে মাটিগুলো ঝুরঝুরে করে আরও ২ দিন অপেক্ষা করে (ফরমালিনের গ্যাস বিতাড়িত করার জন্য) নুতন চারা লাগানো যাবে।
চায়ের আগাছা দমন
চা আবাদীতে চা গাছ ও ছায়াতরু ব্যতীত অনাবশ্যক যে কোন গাছপালাকে আগাছা বলা যেতে পারে। গাছের সঠিক পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য আগাছা দমন অপরিহার্য। কেননা আগাছা পানি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের জন্য চা গাছের সঙ্গে প্রতিযোগীতা করে এবং প্রয়োজনীয় আলো বাতাসও ব্যাহত করে। তাছাড়া পোকামাকড় ও রোগবালাই বিস্তারে সহায়তা করে। সাধারণত নিড়ানী, কোদাল ও কাস্তের সাহায্যে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ পদ্ধতি ব্যয় বহুল, শ্রমনির্ভর ও কষ্টসাধ্য হলেও পরিবেশ বান্ধব। ভরামৌসুমে চায়ের বৃদ্ধি যখন ভাল হয়, পাশাপাশি চা আবাদীতে আগাছার আধিক্যও বৃদ্ধি পায়। তখন শ্রমিক স্বল্পতাহেতু নির্ধারিত মাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগের মাধ্যমে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ এবং এটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় দ্রুত আগাছা দমন করা সম্ভব। তবে উঁচু টিলার উপরে বা খাড়া টিলার ঢালে কোন অবস্থাতেই আগাছানাশক প্রয়োগ করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে চা আবাদীতে যে সকল আগাছাসমূহ জন্মে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ এর সুবিধার্থে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায়। নরম ও অকাষ্ঠলগুলোকে এক-বীজপত্রী এবং শক্ত ও কাষ্ঠলগুলোকে দ্বি-বীজপত্রী আগাছা হিসাবে ভাগ করা হয়ে থাকে। চা আবাদীতে কোন কোন সেকশনে এক-বীজপত্রী এবং কোন কোন সেকশনে দ্বি-বীজপত্রী আগাছা জন্মিয়ে থাকে। আবার কোন কোন সেকশনে এক-বীজপত্রী ও দ্বি-বীজপত্রী উভয় প্রকার আগাছা জন্মিয়ে থাকে। কিছু আগাছা নাশক আছে শুধুমাত্র এক-বীজপত্রী জাতীয় আগাছাকে দমন করে কিন্তু দ্বি-বীজপত্রী আগাছার উপর কাজ করে না। অন্যদিকে কিছু আগাছা নাশক আছে শুধুমাত্র দ্বি-বীজপত্রী জাতীয় আগাছাকে দমন করে কিন্তু এক-বীজপত্রী আগাছার উপর কাজ করে না। আবার কিছু আগাছা নাশক আছে এক-বীজপত্রী ও দ্বি-বীজপত্রী উভয় জাতীয় আগাছাকে দমন করে থাকে। সব আগাছা নাশক সব আগাছা উপর কাজ করে না বিধায় আগাছা নাশক দ্বারা আগাছা দমন করতে গেলে সেকশনের আগাছার ধরণ তথা কোন্ জাতীয় আগাছা বিদ্যমান তা দেখে আগাছা নাশক ব্যবহার করা উচিত।
অন্যদিকে নার্সারীতে আগাছাসমূহ দমন কল্পে দু’ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। (১) স্ট্যান্ডিং নার্সারীতে হাত বাছাই করে এবং (২) নার্সারীর বেডে (চারা লাগানোর পূর্বে) প্রি-ইমার্জেন্ট জাতীয় আগাছা নাশক প্রয়োগ করে।
এক-বীজপত্রী আগাছাসমূহ: দুর্বা ঘাস, ছন ঘাস, মুথা ঘাস, আঙ্গুলী ঘাস ইত্যাদি।
দ্বি-বীজপত্রী আগাছাসমূহ: বাগরাকোট, মিকানিয়ালতা, নিশি, লজ্জাবতী, ঘেটু, কুকর শুঙ্গা, ছোট দুধীয়া, বড় দুধীয়া, কলকা সন্ধা, বিষকাটালী, বন পটল, তেলা কুচি, শ্বেতদ্রোন, থানকুনী ইত্যাদি।
আগাছার দমনকৌশলঃ আগাছানাশক ও এদের হেক্টর প্রতি মাত্রা নিম্নে দেয়া হলোঃ
একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী উভয় প্রকার আগাছা বিদ্যমান থাকলে গ্লাইফোসেট জাতীয় যেমন- রাউন্ডআপ, এমকোরাউন্ড, সানআপ, রিড উইড, বাই মাস্টার @ হেক্টর প্রতি ৩.৫ লি./ ৭৫০ লিটার পানি অথবা প্যারাকোয়াট জাতীয় যেমন- গ্রামোক্সোন, পিলারক্সন, প্যারাক্সোন @ হেক্টর প্রতি ২.৮ লি./ ৭৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
কেবলমাত্র এক-বীজপত্রী আগাছা বিদ্যমান থাকলে ডালাপন @ হেক্টর প্রতি ৬.৭২ কেজি./৭৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
কেবলমাত্র দ্বি-বীজপত্রী আগাছা বিদ্যমান থাকলে ২,৪-ডি জাতীয় যেমন- ২,৪-ডি, কেম এমাইন @ হেক্টর প্রতি ২.৮ কেজি./৭৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।